শেষ যুদ্ধের সৈনিক

মাত্র ১১ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১২ স্কুল দলের হয়ে সেঞ্চুরি করেন এই তরুন তুর্কি। এরপর দ্রুতই গায়ানার স্কোয়াডে সুযোগ পান সারওয়ান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে গায়ানার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন সারওয়ান। ঘরোয়া ক্রিকেটে বছরের পর বছর ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁকে টেনে নেয় জাতীয় দলের দোরগোড়ায়।

২০০০ সালের দিকে পাকিস্তান ক্রিকেট তথা বিশ্বক্রিকেটে সবচেয়ে আলোচিত পেস জুটি ওয়াকার ইউনুস-ওয়াসিম আকরাম। এই দুই পেস ব্যাটারির স্যুইং, পেস, ইয়োর্কার আর বাউন্সের সামনে টেকা ছিল বড় দায়। এই দুই পেসারই তখন নিজেদের সেরা সময় পার করছিলেন।

অপরদিকে, আশির দশকে ক্রিকেট দুনিয়া শাসন করা ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন খর্বশক্তির এক দল। মিডল অর্ডারে ব্রায়ান লারা, শিবনারায়ণ চন্দরপলের উপরই ছিল মূল ভরসা। এ দু’জনের উপর দাঁড়িয়েছিল ক্যারিবিয়ানদের ব্যাটিং অর্ডার। তখন গ্লেন ম্যাগ্রা-ওয়ার্ন কিংবা ওয়াকার-ওয়াসিমদের বিপক্ষে ভিত গড়তে পারবে এমন একজনকে বড্ড প্রয়োজন ছিল ক্যারিবীয়দের।

সেবার ২০০০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গেল পাকিস্তান। পাকিস্তানের পেস অ্যাটাকের সামনে ব্যাটিং বিপর্যয়ের শঙ্কাটা চোখ রাঙাচ্ছিল। বয়সভিত্তিক দলে তখন তরুন এক ক্রিকেটারের বেশ নামডাক। টেম্পারমেন্ট, টেকনিক, স্ট্রোকমেকিং – সবদিক থেকেই সবার নজরে এসেছিল সেই তরুন। অনেকেই ভবিষ্যত তারকা তকমা দিয়ে দিলেন। কিন্তু এই তরুন ক্রিকেটার কি ওয়াসিম-ওয়াকারদের সামনে ক্যারিবীয়দের জন্য ঢাল হয়ে দাঁড়াতে পারবে?

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাউন্সি উইকেটে ওয়াসিম-ওয়াকারদের বিরুদ্ধে অভিষেক হয় ২০ বছর বয়সী রামনারেশ সারওয়ানের। আর অভিষেক ইনিংসেই খেলেন ৮৪ ও ১১ রানের অপরাজিত ইনিংস। পাকিস্তানের আগ্রাসী বোলিং লাইনআপের সামনে প্রমাণ করলেন নিজের সামর্থ্যের। বাকি পথটা সফলতার চাঁদরে মোড়ানো!

গায়ানায় জন্ম হলেও সারওয়ান ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি তাঁর চরম ঝোঁক। তবে খেলার মত ব্যাট ছিল না সারওয়ানের। কাপড় ধোঁয়ার কাজে ব্যবহার করা গাছের তক্তাবিশেষ দিয়েই ক্রিকেট খেলতেন তিনি।

মাত্র ১১ বছর বয়সে অনূর্ধ্ব-১২ স্কুল দলের হয়ে সেঞ্চুরি করেন এই তরুন তুর্কি। এরপর দ্রুতই গায়ানার স্কোয়াডে সুযোগ পান সারওয়ান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে গায়ানার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন সারওয়ান। ঘরোয়া ক্রিকেটে বছরের পর বছর ধারাবাহিক পারফরম্যান্স তাঁকে টেনে নেয় জাতীয় দলের দোরগোড়ায়।

এরপর পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক। ক্যারিয়ারের বাকিগল্পটা নিজের ব্যাটেই লিখেছেন সারওয়ান। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ক্রিকেটার টেড ডেক্সচার ভবিষ্যতবাণী করেন ক্যারিয়ার শেষে পঞ্চাশের বেশি গড়ধারী থাকবেন সারওয়ান! অবশ্য খুব বেশি ভুল বলেননি টেড! টেস্টে ৪০ ও ওয়ানডেতে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৪৩ গড় নিয়ে। ক্যারিয়ারের শেষদিকে অবহেলা আর অধারাবাহিকতার কারণে নিজেকে সেরাদের কাতারে রেখে যেতে পারেননি এই ক্যারিবিয়ান তারকা।

গায়ানার আরেক কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান তারকা চন্দরপলের মত নার্ভ ধরে রেখে লম্বা সময় উইকেটে টিকে থাকতে পারতেন সারওয়ান। ২০০৩ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি সারওয়ানের ক্যারিয়ারে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। ২২৮ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ৬২ রানে তখন ২ উইকেট নেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের।

চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১৫তম ওভারে দিলহারা ফার্নান্দোর বাউন্সারে মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে সারওয়ান। হাসপাতাল থেকে ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে আবারও মাঠে ফিরেন এই তরুন তারকা। এরপর ৪৪ বলে ৪৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেললেও মাত্র ৬ রানের ব্যবধানে হেরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ম্যাচ থেকে ছিটকে যাওয়ার পরেও ওই ম্যাচে সারওয়ানের ব্যাটেই আবার স্বপ্ন দেখেছিল ক্যারিবীয়রা। ম্যাচ হারলেও সারওয়ানের সাহসী সেই ইনিংস প্রশংসা কুঁড়িয়েছিল পুরো ক্রিকেটবিশ্বে। ওই একই বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যান্টিগা টেস্টে ৪১৮ রানের বিশাল টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে সারওয়ান ও চন্দরপলের ১২৩ রানের অনবদ্য জুটি দলকে জয়ের ভীত গড়ে দেয়। চন্দরপলের ১০৪ ও সারওয়ানের ১০৫ রানের অসাধারণ ইনিংসে থ্রিলিং ম্যাচ জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখন অবধি এটি টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান করার রেকর্ড!

২০০৬ সালে নিজের জন্মদিনে অনন্য এক রেকর্ডে নাম লেখান সারওয়ান। ২৬ তম জন্মদিনে ভারতের বিপক্ষে সেন্ট কিটস টেস্টের দ্বিতীয় দিনে মুনাফ প্যাটেলের এক ওভারে ৬ চার মারেন এই ক্যারিবিয়ান তারকা। ওই ইনিংসে ১১৬ রান করেন সারওয়ান। সন্দ্বীপ পাতিল ও ক্রিস গেইলের পর ইতিহাসের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে টানা ৬ বলে ৬ চার মারেন তিনি।

ব্রায়ান লারার যুগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডল অর্ডারের অন্যতম ভরসা ছিলেন তিনি। লারা পরবর্তী সময়েও দলের হাল ধরেন সারওয়ান। ২০০৯ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা ২৯১ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।

২০০৬ সালে বাজে ফর্মের কারণে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে বাদ পড়েন সারওয়ান। ৬ বছরের ক্যারিয়ারে প্রথমবার বাজে ফর্মের কারণে বাদ পড়েন তিনি। অবশ্য দ্রুতই আবার প্রত্যাবর্তন হয় এই তারকার। ২০০৭ সালের ২৯ এপ্রিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য সারওয়ানকে অধিনায়ক করা হয়। তবে ইনজুরির কারণে খুব বেশি সময় এই দায়িত্বে থাকতে পারেননি তিনি।

এরপর ২০০৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরির মধ্য দিয়ে সর্বকনিষ্ঠ ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার হিসেবে ৫ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সারওয়ান। ধীরে ধীরে ফিটনেস ইস্যু আর ফর্মহীনতায় ছিটকে পড়েন এই তারকা ক্রিকেটার। এরপর নিজের অবহেলা, বোর্ডের সাথে ঝামেলা – সব মিলিয়ে আর জাতীয় দলে ফিরতে পারেননি তিনি।

টেস্ট ফরম্যাটে ৮৭ ম্যাচে ৪০ গড়ে করেছেন ৫৮৪২ রান। ওয়ানডে খেলেছেন ১৮১টি। এই ১৮১ ম্যাচে ৪৩ গড়ে করেছেন ৫৮০৪ রান। ১৮ টি-টোয়েন্টিতে ১০৪ স্ট্রাইক রেটে আছে ২৯৮ রান। ঘরোয়া ক্রিকেটে এই ক্যারিবিয়ান তারকার ঝুলিতে আছে প্রায় ২৩ হাজার রান!

বোর্ডের সাথে ঝামেলায় না জড়ালে কিংবা ফর্ম ধরে রাখতে পারলে নিঃসন্দেহে তিনি খেলে যেতে পারতেন আরও বছর কয়েক! সামর্থ্যের তুলনায় তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের জার্সিতে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে পারেননি বলেই মনে করা হয়!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...