ঘর ছাড়া এক ক্রিকেট কুমার!

নয় বছর আগে মাত্র পনেরো বছর বয়সী এক ছেলে ঘর ছেড়ে দিলো। ব্রত নিল, ‘কিছু একটা করে তবেই ফিরবো ঘরে।’ সেই অদম্য কিশোর আর কেউ নন, কুমার কার্তিকিয়া সিং। কি পরিমাণ জেদ আর আত্মবিশ্বাসী হলে সদ্য কৈশোরে পা দেয়া একটা ছেলে এমন সাহস দেখায়!

কার্তিকিয়া নি:সন্দেহে কিছু একটা করেছেন। কেবল কিছু একটা না, বরং বিশাল কিছুই করেছেন। ফাইনালে নিজের সেরাটা দিয়েছেন, মধ্যপ্রদেশকে শিরোপা জেতাতে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন। রঞ্জি ট্রফি ফাইনালে ৪১ বারের চ্যাম্পিয়ন মুম্বাইকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে মধ্যপ্রদেশ। ৮৭ বছরের ইতিহাসে মোড়া রঞ্জি ট্রফি। এই দীর্ঘ ইতিহাসে প্রথমবারের মত যুক্ত হল মধ্যপ্রদেশ নামক এক পাতা।

আর এই মধ্যপ্রদেশের বোলিং বিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছেন কুমার কার্তিকিয়া। ফাইনালে একাই পাঁচটি উইকেট শিকার করেন তিনি। তবে এবার কি ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন? বীরদর্পে গিয়ে পরিবারকে আলিঙ্গন করে জানান দেবেন দেখো আমি বিশাল কিছু করেছি?

টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কার্তিকিয়া বলেন, ‘নয় বছর দুই মাস তিনদিন হয়েছে আমি আমার বাবা-মার সাথে দেখা করিনি।’ কবে ঘরে ফিরবেন এই প্রশ্নের উত্তরে এই বাঁহাতি স্পিনার বলেন, ‘আশা করি আর কিছুদিন পর। আমি তখনই ফিরবো যখন আমি ২০-২৫ দিন ছুটি কাটাতে পারবো তাদের সাথে। কারণ অনেককাল আমি তাদের দেখিনি।’

কুমার কার্তিকিয়ার বাবা শ্যামনাথ সিং পেশায় ইউপি পুলিশের হেড কনস্টেবল। তিনি জানান তিনি ও কার্তিকেয় এর মা অধীর আগ্রহে ছেলের ঘরে ফেরার প্রহর গুণছেন। কার্তিকেয় কেন ঘর ছেড়েছেন সে কারণ জানতে চাইলে তাঁর বাবা বলেন, ‘যখন ইউপি অনূর্ধ্ব ১৬ তে সে(কার্তিকিয়া) সুযোগ পেলনা, ক্রিকেটে একদিন নাম করে তবেই সে ঘরে ফিরবে এমন প্রতিজ্ঞা নিয়ে সে ঘর ছেড়ে চলে যায়।’

২০১৫ তে ঘর ছেড়ে দিল্লিতে পারি দেয়ার পর রাঁধে শ্যাম নামে বন্ধুর সাথে দেখা করেন। রাঁধে তখন স্থানীয় পর্যায়ে  ক্রিকেটে খেলতো এবং তাকে সঞ্জয় ভার্দওয়াজের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যিনি তাঁর একাডেমীতে গৌতম গম্ভীর ও অমিত মিশ্রদের মতো ক্রিকেটারদের তৈরী করেছিলেন। সঞ্জয় বলেন, ‘তাকে আমি নেটে বল করতে বলি, এবং তাঁর প্রথম ডেলিভারিটি যথেষ্ট ছিল তাঁর প্রতিভা টের পাওয়ার জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি যখন জানলাম সে প্রতিদিন অনুশীলনে আসতে গাজিয়াবাদ থেকে অশোক বিহারে চারঘন্টা জার্নি করতো আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। একদিন যখন আমি তাকে আমার সাথে দুপুরের খাবার খেতে বললাম, তখন সে জানালো গত এক বছরে একবারও সে ঠিকমতো দুপুরের খাবার খায়নি। রাতের শিফটে সে গাজিয়াবাদে ফ্যাক্টরিতে কাজ করতো আর সারাদিন নেটে অনুশীলন করতো।’

সঞ্জয় ভার্দওয়াজ এখন তরুণ ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করতে কার্তিকিয়া হার না মানার গল্পটি বলেন।

কার্তিকেয় জেদের বশে দিল্লিতে আসার পর বেঁচে থাকতে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে তাঁকে। জীবনের ওই সময়গুলো বেশ কঠিন ছিল, কিন্তু কার্তিকেয় তা নিয়ে কোন আফসোস করেননা। তিনি রাতে শ্রমিকের কাজ করতেন, বাসভাড়ার দশ টাকা বাঁচানোর জন্য পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন। এমনকি পুরো একটা বছর তিনি দুপুরের খাবার না খেয়ে কাটিয়েছেন। কিন্তু কখনোই পেটের ক্ষুধা তার সাফল্যের ক্ষুধাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

কার্তিকেয় এর জীবনে ‘গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল’ রূপে এসেছিলেন কোচ সঞ্জয় ভার্দওয়াজ । তিনি তাকে ট্রেনিং একাডেমীর একজন বাবুর্চির সাথে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেন যাতে সে ক্রিকেটে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারে। তার মতে, ‘কার্তিকিয়া দুই বছর ধরে খুব ভালো খেললেও দিল্লি তাকে দলে সুযোগ দেয়নি। যেহেতু সে ট্যালেন্টেড ছিল আমি চাচ্ছিলাম সে একটি সুযোগ পাক।’

পরে সঞ্জয়ই তাকে শাহদল ডিভিশন ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন এর কর্তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সেখানে একজন অতিথি ক্রিকেটার খেলতে পারতেন, কার্তিকিয়া সেই সুযোগটি পেল। ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক হয়। প্রথম রঞ্জি ম্যাচে তিনি দু’টি উইকেট নিয়েছিল। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। গেল আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে তাকে দলে ভেড়ায়।

ধীরে ধীরে সবই তো পাচ্ছেন কার্তিকেয়। হাঁটি হাঁটি পা পা করে খুব শীগ্রই হয়তো জাতীয় দলে সুযোগটুকু ও মিলে যাবে। কিন্তু তার ঘরে ফেরা? সেই সুযোগ ও আসবে হয়তো খুব জলদিই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link