আফিফদের আর কত আঁটকে রাখবেন!

ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের পায়ের তলায় মাটি আছে। টেস্ট ক্রিকেটেও কখনো কখনো লড়াই করা যায়। তবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যেন আমাদের ঠিক আসেনা। শুধু মাঠের ক্রিকেটে নয়, আমাদের শরীরি ভাষা, দৈহিক গঠন, গোলটেবিলে কিংবা মাঠের পরিকল্পনা কোনটাই ঠিক টি-টোয়েন্টি সূলভ নয়, আক্রমণাত্মক নয়।

আমাদের মধ্যে কেমন একটা পলায়নপর ব্যাপার আছে। আমাদের অধিনায়কের মধ্যে এটা সবচেয়ে বেশি থাকায় পুরো দলের মধ্যেই সেটা ছড়িয়ে পরে। তবুও যেই দুই একজন এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চান। তাঁদের ভয় দেখানো হয়, “বাইরে জুজু আছে, যেও না।”

গত এক বছরে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে যে ছেলেটা ব্যাট হাতে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনার সঞ্চার করেছে তাঁর নাম আফিফ হোসেন ধ্রুব। আফিফও হয়তো ঠিক পাওয়ার হিটার নন। তবে তাঁর কব্জির জোর আছে। সবচেয়ে বড় কথা আফিফ নিজের দুর্বলতাটা বোঝেন। ফলে জোরে মারার চেষ্টাও করেননা। তিনি নিজের সামর্থ্যের উপর ভরসা রাখেন, অপেক্ষা করেন। আপনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা দেখে থাকলে এই ব্যাপারে আপত্তি জানাতে পারবেন না।

আফিফের ব্যাট থেকে ৩৮ বলে ৫০ রানের ইনিংস এসেছে। মূলত তাঁর এই ইনিংসেই একটা সম্মানজনক স্কোর করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। তবে এই পুরো ইনিংসে একটা শট আপনার চোখে লেগে থাকতে বাধ্য। ইনিংসের ১২তম ওভারে আফিফের করা একটা ফ্লিক। কোনরকম গায়ের জোরে নয়, বলের লাইনে গিয়ে টাইমিং আর কব্জির কারুকাজ। এমন একটা শট বার্তা দেয় আফিফের কোয়ালিটি সম্পর্কে, ম্যাচুরিটি সম্পর্কে।

শুধু এই ম্যাচে নয়, গত এক বছর ধরেই আফিফ বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টিতে পারফর্ম করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের অন্য ব্যাটসম্যানরা যেখানে ডট বলের উৎসব করেন মূলত সব বলেই বাউন্ডারি আদায় করার চেষ্টা করতে গিয়ে তখন আফিফ অপেক্ষা করেন। ভালো বলগুলো থেকে সিংগেল, ডাবলস বের করেন। গ্যাপ গলিয়ে মাঠের পুরো ব্যবহার করেন। রানের চাকা সচল রাখেন এবং বাজে বল পেলেই কাজে লাগান। ফলে তাঁর স্ট্রাইকরেট অন্যদের থেকে ভালো হয়।

কিন্তু এই স্ট্রাইকরেট বেশি হওয়াটার ভুল ব্যাখ্যা বের করেছে বাংলাদেশ দল। মূলত বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। তিনি তাঁকে রীতিমত স্লগার বানিয়ে ছয়-সাতে ব্যাট করতে পাঠান এবং কোন এক অজানা কারণে নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন দেন।

গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময়েই আফিফের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে অধিনায়ককে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি তখনো আফিফকে ছয়-সাতে খেলানোর কথাই বলেছিলেন।

কিন্তু আফিফ উপরে খেললে যে দলেরই ভালো সেটা বোঝার চেষ্টা করেননি। আফিফ সময় পেলে দলের ইনিংস বড় করতে পারেন। চাপের সময়েও সিংগেল, ডাবল নিয়ে রানের চাকা সচল রাখতে পারেন। এছাড়া কব্জির জোরে বাউন্ডারি বের করার ক্ষমতা তো তাঁর আছেই। ফলে আফিফকে বাইশ গজে যত বেশি সময় দেয়া যায় তিনি তত বেশি কার্যকরি হয়ে উঠবেন।

এই প্রসঙ্গে অবশ্য আফিফ দ্বিধার কোন অবকাশ রাখেননি। এই ফরম্যাটে আফিফ যতগুলো ৩০+ ইনিংস খেলেছেন তাঁর সবগুলোই এসেছে যখন আফিফ প্রথম দশ ওভারের আগে ব্যাট করতে নেমেছেন। সেগুলোতে তাঁর স্ট্রাইকরেটও বেশ প্রশংসনীয়।

যেমন শেষ টি-টোয়েন্টিতেও তিনি চারে ব্যাট করতে নেমেছিলেন এবং তখন ইনিংসের মাত্র ষষ্ঠ ওভার চলছে। ফলে তিনি নিজের মত করে খেলার সময় পেয়েছেন। ব্যাটিং করেছেন প্রায় ১৩২ স্ট্রাইকরেটে। কিন্তু বিজি ক্রিকেটার আফিফকে বাংলাদেশ দল বানিয়ে দিয়েছে স্লগার।

ছয়-সাতে নেমে তখন আর আফিফের আসলে কিছুই করার থাকেনা। তিনি এমন ব্যাটসম্যান নন যে নেমেই প্রতি বলে চার-ছয় মারবেন। তাঁকে ইনিংসটা সাজানোর সময় দিতে হবে। উপরে নামালে তিনি যে কাজটা পারেন সেটা আফিফ অসংখ্য বার প্রমাণ করেছেন। এমনকি ওয়ানডে ক্রিকেটেও দল বিপদে পড়লে তিনি হাল ধরেছেন। আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশকে ম্যাচ জিতিয়ে দেয়া আফিফের ইনিংসটা নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি।

তবে এসবকিছুতেই আসলে বাংলাদেশ দল তাঁদের পরিকল্পনা থেকে সরে আসছে না। গতকাল চারে নেমে এমন ইনিংস খেলা আফিফও খুব সম্ভব পরের ইনিংসে আবার ছয়-সাতে চলে যাবেন মুশফিককে জায়গা দিতে গিয়ে। যদিও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে গত কয়েক বছরে মুশফিকুর রহিমের স্ট্রাইক রেট ও ব্যাটিং এপ্রোচ আরো ভয়াবহ। তবুও চার নাম্বারে মুশফিকের জায়গা পাকা।

ওদিকে রিয়াদও অধিনায়ক হবার পর নিজেকে প্রমোশন দিয়ে পাঁচে নিয়ে এসেছেন। অথচ তাঁর ব্যাটিংটা এখন আর কোনভাবেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সাথে যাচ্ছেনা। ফিল্ডির হিসেবেও প্রায় প্রতি ম্যাচেই বড় কোন ভুল করছেন। এসবেরর মাঝে আফিফদের আর বাইরে বের হওয়া হয়না, যারা অন্তত অন্ধকার ঠেলে আলোর পথটা খোঁজার চেষ্টা করেন।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link