না, তার পায়ে স্কিলের ফুলঝুরি নেই। নেই ক্ষীপ্রতা কিংবা অবিশ্বাস্য গতি। এমনকি গতানুগতিক ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারদের মতো দুর্ধর্ষ ট্যাকেল করতেও জানেন না। তারপরও কোন এক জাদুমন্ত্রে স্পেন আর বার্সেলোনার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার পজিশনটা তিনি দখল করে আছেন লম্বা সময় ধরে।
এতক্ষণে বোধহয় রুগ্ন চেহারার এক খেলোয়াড়ের চেহারা ভেসে ওঠার কথা – তিনি যে সার্জিও বুস্কেটস সেটাও আর আলাদা করে বলে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
সাজিও বুস্কেটসের জন্ম ১৯৮৮ সালের ১৬ জুলাই। বেড়ে উঠেছেন এক কাতালান পরিবারে। বাবা কার্লোস বুস্কেটস খেলতেন বার্সেলোনাতে, তাই সন্তানেরও হাতেখড়ি হয় বার্সার একাডেমি লা মাসিয়াতে। ছোট থেকেই শান্ত প্রকৃতির বুস্কেটস বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলের এগারো পজিশনের মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচিত পজিশন, মধ্যমাঠের নিচের দিকটা।
এরপর থেকে ডিফেন্সিভ মিডের তালিম নিতে থাকেন তিনি। ২০০৫ সালে বার্সেলোনার জুভেনিল দলে সুযোগ পান বুস্কেটস।
২০০৮ সালের কথা, বার্সেলোনার মূল দলে সুযোগ দেয়ার জন্য তৎকালীন কোচ পেপ গার্দিওলা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন লা মাসিয়ান তরুণদের। জহুরির চোখ হীরে চিনতে ভুল করেননি। বার্সেলোনার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন সার্জিও বুস্কেটসের হাতে।
ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন দুই মহারথী ইনিয়েস্তা আর জাভির সাথে। বার্সার মধ্যমাঠে তাদের তিনজনের মাধ্যমে শুরু করেছিল অল মাসিয়ান ট্রায়ো।
এরপর কেটে গিয়েছে এক যুগেরও বেশি। ইনিয়েস্তা, জাভিদের সাথে বুস্কেটসের কল্যাণে ইউরোপ শাসন করেছে কাতালানরা। একদিকে রক্ষণে সাপোর্ট দেয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছিলেন বুস্কেটস ফলে বাকি দুইজন পেয়েছিলেন পুরো মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর লাইসেন্স।
পাসিং, পজিশনিং, গেম রিডিং এসব যে শিল্প সেটা প্রমাণ করাই সম্ভবত সার্জিও বুস্কেটস এর ক্যারিয়ারের লক্ষ্য। বুস্কেটস তার রুগ্ন শারীরিক গড়নের সমস্যাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হালকা পাতলা শরীরকেই ব্যবহার করেছেন অনন্য অসাধারণ ভাবে। সার্জিও দলে থাকা মানে অন্য খেলোয়াড়রা পায় বাড়তি সুবিধা।
ডিফেন্ডারদের যেমন গোল আটকাতে সমস্যা কম হয়, তেমনি ডিফেন্স চেরা পাস দেয়ার ক্ষেত্রেও কার্যকর দুর্দান্ত পজিশনিং সেন্স সম্পন্ন বুসি। তাই হয়তো তাকে নিয়ে বলাই যায়, ‘The attack starts with his pass and opponent’s attack stops here.’
পজিশনিং, পাসিং, গেম রিডিং, প্রেস রেসিস্ট, ম্যাচের টেম্পো কন্ট্রোলিং এসব যদি হয় একজন সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার তাহলে সার্জিও বুস্কেটস নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সেরাদের একজন। তাঁর থেকে যোগ্য কাউকে মনে হয় পাওয়া সম্ভব নয়।
পৃথিবীর আবর্তনে গড়িয়েছে সময়। ক্যারিয়ারের অবসান ঘটিয়ে একসময়ের কিংবদন্তি সহযোদ্ধা জাভি হার্নান্দেজ এখনও তারই কোচ। আরেক সঙ্গী ইনিয়েস্তা বিদায় বলেছেন ইউরোপীয় ফুটবলকে। একজন এখনো ধ্রুব, তিনি সার্জিও বুস্কেটস। বটগাছের মতই আগলে রেখেছেন ব্লাউগানাদের মধ্যমাঠ।
দ্রুতগতির কোন ফরোয়ার্ডের কাছে হয়তো কখনো কখনো পিছিয়ে পড়েন সার্জিও বুস্কেটস। বর্ষীয়ানের গায়ে লাগিয়ে দেয়া হয় ফিনিশড ট্যাগ। তবে আবার ফিরে আসতেও সময় লাগে না বুসির। সঠিক কৌশল আর ট্যাকটিক্সে বুস্কেটস যে এখনো অপ্রতিরোধ্য সেটি বারবার প্রমাণ করেছেন তিনি।
বর্তমান বার্সেলোনার তারুণ্যে ঠাঁসা মিডফিল্ডে তিনি জায়গা ধরে রেখেছেন, পারফর্ম করছেন সমানতালে। অন্যদিকে লুইস এনরিকের নতুন প্রজন্মের স্পেনের কেন্দ্রীয় খেলোয়াড়ের ভূমিকা পালন করেন সার্জিও বুস্কেটস।
এমনকি সর্বশেষ উয়েফা ন্যাশন্স লিগে এমবাপ্পে, বেনজেমার মত তারকাদের হটিয়ে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট জিতে নিয়েছেন বার্সা কিংবদন্তি। ২০২১ ইউরো-তে যে দুইটি ম্যাচ খেলেন নি বুসি, সেসব ম্যাচ অনুসরণ করলেই বোঝা যায় তাকে ছাড়া পুরো স্পেন দল প্রায় ছন্নছাড়া হয়ে যায়।
লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, কোপা দেল রে, উয়েফা সুপার কাপসহ ক্যারিয়ারে সম্ভাব্য সবল দলীয় অর্জনে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন সার্জিও বুস্কেটস। ডিফেন্সিভ মিডমিল্ডার পজিশনে দাঁড়িয়ে দলকে বাঁচিয়েছেন কত শত বার।
এত এত কৃতিত্বের পরেও বিনয়কেই বানিয়েছেন নিজের আশ্রয়। এত বছরের গৌরবমন্ডিত পেশাদার ক্যারিয়ারে কোনো বিতর্ক ছুঁয়ে দেখতে পারেনি তাঁকে।
এই কাতালান ভদ্রলোকের বয়স অনেক আগেই পেরিয়েছে ত্রিশের কোটা। আর কয়েকটা দিন পরেই তুলে রাখবেন বুটজোড়া। আর তখন সমাপ্ত হবে নীল মেরুণ জার্সির এক বিষাদ-শান্ত নীরবতা। তারপরও তিনি থেকে যাবেন কিউলদের মাঝে।
জাভি-ইনিয়েস্তা যুগ থেকে পেদ্রি-গাভির সময় পর্যন্ত যারা বার্সেলোনার খেলা দেখেছে, তাদের সবার হৃদয়ে ভাসবে এই নীরব তারকার ছবি; তারা সবাই মনে রাখবে একজন অক্টোপাসের লড়াইয়ের কথা।