অনিয়মের মাঝেই নিয়ম খুঁজি

১৮ জুলাই, ২০২২। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক উইকেট রক্ষক ব্যাটসম্যান দিনেশ রামদিন বিদায় বলে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে। এবার একই দিনে সেই একই পথ অনুসরণ করলেন উইন্ডিজের আরেক পুরোনো দিনের সাথী। তিনি লেন্ডল সিমন্স, এক সময়ের সতীর্থ রামদিনের মতই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়েই নিজের সমাপ্তির কথা প্রকাশ করলেন।

অবশ্য এর আগে নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ডকে জানিয়ে রেখেছিলেন অবসরের ব্যাপারে। আপাতত তার ভাবনায় শুধুই ফ্রাঞ্চাইজি আর ঘরোয়া ক্রিকেট। তবে বয়স ইতোমধ্যে ৩৭ হয়ে গিয়েছে, ব্যাট হাতে আর হয়তো বেশিদিন তাকে বাইশ গজে দেখা যাবে না।   

ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক টেস্ট খেলোয়াড় ফিল সিমন্স সম্পর্কে লেন্ডল সিমন্সের চাচা। খুব সম্ভবত তাঁর দেখা দেখি লেন্ডলও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন জাতীয় দলে খেলার। আর সেই স্বপ্ন পূরনের পথে যাত্রা শুরু হয় ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগোর হয়ে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এই দলের হয়ে নিজের ক্রিকেটীয় সামর্থ্যের প্রমাণ দেন লেন্ডল সিমন্স। 

জাতীয় দলের ভাবনায় লেন্ডল সিমন্স এসেছিলেন অনেক আগেই। সেই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র ১৭ বছর বয়সেই সুযোগ পান ২০০২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে। এছাড়া ২০০৪ সালে যুব দলের পরের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সাথে বাংলাদেশে আসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ২০০৬ সালে জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন বাস্তবে পরিনত হয় সিমন্সের জন্য।

সে বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতে অভিষেক হয়েছিল এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের। ঠিক পরের বছর ওভালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দলে প্রথম সুযোগ পান তিনি। তবে সাদা পোশাকে দলে আসতে সময় লাগে সিমন্সের। ২০০৯ সালে ‘ইংল্যান্ড এ’ দলের বিপক্ষে ২৮২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিসং খেলে নজর কাড়েন নির্বাচকদের। সে বছরই ইংলিশদের বিপক্ষে টেস্ট ক্যাপ পেয়ে যান ক্যারিবীয় তারকা। 

অবশ্য আন্তর্জাতিক টেস্টে একেবারেই ম্লান ছিলেন লেন্ডল সিমন্স। অভিষেকের মাত্র দুইবছর পরে বাংলাদেশের বিপক্ষে নিজের শেষ টেস্ট খেলেছিলেন তিনি ৷ আট ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে কখনো অর্থ শতকের দেখা পাননি, ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস মাত্র ৪৯ রানের। সব মিলিয়ে এই ফরম্যাটে ১৭.৩৮ ব্যাটিং গড়ে ২৭৮ রান করেছিলেন তিনি। যদিও রঙ্গিন পোশাকে তুলনামূলক ভাল পারফর্ম করেছেন তিনি। 

নিজের ক্যারিয়ারে ৬৮টি করে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন লেন্ডল সিমন্স। এর মাঝে ওয়ানডে ১৯৩৮ করে থেমে গিয়েছিলেন ২০১৫ সালেই। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে খেলার আগে দুই সেঞ্চুরি আর ষোলটি হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ব্যাটিং গড় ৩১.৫৮।

অন্যদিকে, টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট ছিল লেন্ডল সিমন্সের সবচেয়ে প্রিয় ফরম্যাট। ১২০ স্ট্রাইক রেটে ১৫২৭ রান করেছেন তিনি; কোন সেঞ্চুরি না পেলেও নয়টি অর্ধশতক করে প্রমাণ দিয়েছিলেন তার ব্যাটিং দক্ষতার। সর্বশেষ ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হয়ে খেলেছিলেন সিমন্স। 

অন্য অনেক ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারের মতই লেন্ডল সিমন্সকে আসলে সংখ্যা দিয়ে মাপা যায় না। আজন্ম তিনি বিনোদন দিয়ে গিয়েছেন বিশ্বের নানা প্রান্তের দর্শকদের, চার ছক্কার মারে মোহিত করেছিলেন সব বয়সের সমর্থকদের। খেলেছেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে, ২০১৫ এবং ২০১৭ সালে দলটির চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে অনস্বীকার্য অবদান ছিল তার।

এছাড়া করাচি কিংসের হয়ে পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) মাতিয়েছেন এই পাওয়ার হিটার। বাংলাদেশের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতেও আছে তার স্মৃতি। চিটাগং ভাইকিংস এবং সিলেট সানরাইজার্সের হয়ে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন তিনি। নিজের দেশের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক লেন্ডল সিমন্স। 

লেন্ডল সিমন্সের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হাই লাইটস ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল সেবার শিরোপা জিতেছিল, আর সামনে থেকে সেই জয়ে অবদান রেখেছিলেন এই টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। বিশেষ করে সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৫১ বলে ৮২ রানের এই ঝড়ো ইনিংস ম্যাচের গুরুত্ব বিবেচনায় টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের-ই অন্যতম সেরা নক। 

আন্দ্রে রাসেল, কাইরন পোলার্ডদের মত পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে একজন বিনোদনের ফেরিওয়ালা ছিলেন লেন্ডল সিমন্স। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটে তাকে ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি বললেও খুব একটা ভুল হয় না। কিন্তু নিজের অর্জনের তুলনায় যথেষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া হয়নি সিমন্সের। অনিয়মের বেড়াজালে বন্দী হয়েই ইতি ঘটে তাঁর ক্যারিয়ারের।

অফ ফর্ম আর বয়সের ভারে জাতীয় দলে অনেকদিন থেকেই ব্রাত্য সিমন্স। এবার তো আনুষ্ঠানিকভাবেই অবসর নিয়ে নিয়েছেন। তবে তাকে তার নাম মুছে ফেলা যাবে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের কথা যতবার মনে করা হবে, ততবারই স্মরণ করতে হবে লেন্ডল সিমন্সকে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link