যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটা দেশ। নয়টা মাস দেশের সব যুবকের হাতে ছিল ভয়ংকর সব মারণাস্ত্র। একটা চাপা শঙ্কা তখন। দেশের যুবসমাজের বিপথে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিল। সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনার উপায়টা কি? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিশ্চয়ই সে চিন্তাই করছিলেন।
ক্রীড়া আর সংস্কৃতি, এই দুই হতে পারে মুক্তির পথ। দেশটা তো মুক্তি পেল। তখন দরকার ছিল যুবসমাজের মুক্তির। সে মুক্তির পথিকৃত হয়ে দৃশ্যপটে হাজির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জেষ্ঠ্যপুত্র শেখ কামাল। নতুন এক যুদ্ধে জড়িয়ে যান শেখ কামাল। স্বাধীন বাংলাদেশকে ক্রীড়াঙ্গনেও সমৃদ্ধ করতে চেয়েছিলেন তিনি।
১৯৪৯ সালের পাঁচ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুনেচ্ছা মুজিবের কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন শেখ কামাল। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়ার ঠিক এক বছর বাদেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম তাঁর। ছেলে বেলা থেকেই দুরন্তপনা করে বেড়িয়েছেন, ছুটেছেন দিগন্তজোড়া খেলার মাঠে।
শুধু খেলাধুলার প্রতিই যে তাঁর আগ্রহ ছিল বিষয়টা তেমন নয়। ক্রীড়া থেকে শুরু করে সংস্কৃতি, সর্বত্রই যেন ছিল তাঁর বিচরণ। একজন মননশীল মানুষ হয়ে গড়ে উঠবার কোন কমতি তিনি রাখেননি। তিনি সে কমতিটা রাখতে চাননি স্বাধীন বাংলাদেশের যুবসমাজের মাঝেই। তিনি চেয়েছিলেন এক সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে। নিজে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট ও বাস্কেটবল খেলেছেন। কিন্তু তিনি একজন ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে বেশি প্রসিদ্ধ ছিলেন।
সাংগঠনিকভাবে সুদক্ষ শেখ কামালের ইচ্ছে ছিল ফুটবলকে এই বাংলার প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে দেওয়ার। সে লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে, স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আবাহনী ক্রীড়াচক্র। ধারণা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের ফুটবলের অগ্রসর হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদানটাই রেখেছিলেন শেখ কামাল।
এখনও ঠিক বীরদর্পে বাংলাদেশের প্রথম বিভাগ ফুটবলে খেলে যাচ্ছে আবাহনী ফুটবল ক্লাব। পিছিয়ে নেই ক্রিকেট কিংবা হকিও। সময়ের পরিক্রমায় আবাহনী ক্রীড়াচক্র থেকে নাম খানিকটা পালটে হয়েছে আবাহনী লিমিটেড। তবে শেখ কামালের অবদান কিংবা স্মৃতি যেন পালটায়নি এক বিন্দু। কেননা মাত্র তিন বছরের মাথায় আবাহনীকে বানিয়েছিলেন অন্যতম সেরা ক্লাব। এখনও তাঁর জন্মদিনের দিন রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত মাঠে ক্রীড়াপ্রেমীদের সমাগম হয়।
আধুনিকতার ছোঁয়ায় রাজধানীর মাঠগুলো আজ প্রায় বিলুপ্ত। তবুও শেখ কামালের স্মৃতি বিজড়িত মাঠটি এখনও এক ফালি স্বস্তি হয়ে স্বস্থানেই রয়েছে। তবে এক ফুটবলেই অবদান রেখেই ক্ষান্ত হননি শেখ কামাল। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সম্মুখ যুদ্ধ করতে না পারার আক্ষেপটা তিনি ঘুচাতে চেয়েছিলেন দেশ গড়ার কাজে নিজেকে সপে দিয়ে।
তিনি সে কাজটাই করে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর জোর গুঞ্জন ছিল ক্রিকেট খেলা সম্ভবত বন্ধ হয়ে যাবে বাংলাদেশে। এমন একটা গুঞ্জনের প্রেক্ষিতে নিজের পিতার বিপক্ষেই আন্দোলনে নেমে পড়েছিলেন শেখ কামাল। স্লোগানও দিয়েছেন। ঠিক এতটাই নিবেদিত প্রাণ ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন তিনি।
মাত্র চার বছরের মাথায় তিনি ক্রীড়াঙ্গনে আমুল পরিবর্তন এনেছিলেন। প্রায় প্রতিটা খেলার উন্নয়নে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছিলেন শেখ কামাল। এটা বিশ্বাস করা হয় যে তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের সফলতার গ্রাফচিত্রটা বেশ সমৃদ্ধ হত। তবে ১৫ আগস্টের কালরাত বাংলাদেশের এই সূর্যসন্তানকেও ছাড় দেয়নি।
তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সম্মান জানাতে ভোলেনি ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর অবদান। তাইতো ‘শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার’ দেওয়া হয় ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রাখা প্রতিটি মানুষকেই। সেটা সংগঠক কিংবা খেলোয়াড় কোন গণ্ডিতে আটকে থাকে না। তবে তাঁর অকাল প্রয়াণে একটা বিষন্নতা ছড়িয়েছিল ক্রীড়াঙ্গনে। আর সেই সাথে নিজের গতিপথে থমকে গিয়ে কয়েক দশক পিছিয়ে যায় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন।