দ্য মোজার্ট অফ ফুটবল

কোনো সন্দেহ ছাড়াই বলে দেয়া যায় হিচককের থ্রিলার সিনেমার চাইতে কোনো অংশেই কম নয় ম্যাথিয়াস সিন্ডেলারের জীবন। ফুটবল, নাৎসি পার্টি আর রহস্যময় মৃত্যু- এই তিন এক বিন্দুতে এসে মিশেছে সিন্ডেলারের জীবনে। কে এই ম্যাথিয়াস সিন্ডেলার?

ফুটবল ইতিহাসের এত এত মহাতারকার মাঝে সিন্ডেলারের নামটা বিস্মৃত হওয়াটা দোষের কিছু না। তবে অস্ট্রিয়াতে এখনো তাকে স্মরণ করা হয় গভীর শ্রদ্ধার সাথে, তাদের ইতিহাসের সেরা ফুটবলার হিসেবে। সিন্ডেলারের জন্ম ১৯০৩ সালে, মোরাভিয়াতে। বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের অংশ হলেও, তখন মোরাভিয়া ছিল অস্ট্রিয়ার অংশ।

জন্মের পরপরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বাবাকে হারান সিন্ডেলার। ফলে দারিদ্র্যের কষাঘাতে, নির্মম বাস্তবতার সাথে খুব অল্প বয়সেই পরিচয় হয় তাঁর। তবে সবকিছু ভুলে যেতেন তিনি, যখন ভিয়েনার রাস্তায় বল পায়ে নামতেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে হার্থা ভিয়েনায় যোগ দেন তিনি। সেখানে ছয় বছর কাটানো পর যোগ দেন অস্ট্রিয়া ভিয়েনায়। পরের দুই দশক সিন্ডেলার আর অস্ট্রিয়া ভিয়েনা ছিল একে অন্যের পরিপূরক। তার ছোটখাটো আকৃতির জন্য দর্শকরা তাকে ভালোবেসে ডাকতেন ‘ডের প্যাপিয়েননে’ নামে।

তখনকার দিনে পুরো ভিয়েনা শহরটা সিন্ডেলারের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। মিউজিক বার থেকে ক্যাফে – সবখানেই আলোচিত হত ফুটবলের মাঠে তার অনিন্দ্য সব কীর্তির গল্পটা। একারণে তাকে বলা হতো ‘দ্য মোজার্ট অফ ফুটবল’। অস্ট্রিয়া ভিয়েনাকে অস্ট্রিয়ান কাপ জেতান পাঁচবার। তবে সিন্ডেলারের সবচেয়ে বিধ্বংসী রূপ দেখা যায় জাতীয় দলের কোচ হুগো মেইসলের সাথে পরিচয় হওয়ার পর। মেইসল সিন্ডেলারের কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে জানতেন।

তাঁদের যুগলবন্দিতে টানা ১৪ ম্যাচ অপরাজিত ছিল অস্ট্রিয়া। সে সময়ের অস্ট্রিয়াকে ডাকা হতো দ্য ওয়ান্ডার টিম। কেবল প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা নয়, রীতিমতো ধ্বংস করে দিতো অস্ট্রিয়া। হাঙ্গেরিকে ৮-২, জার্মানি আর ফ্রান্সের জালে যথাক্রমে ছয় এবং চার গোল দেয়া প্রমাণ করে কতটা ধ্বংসাত্নক ছিল সেসময়ের অস্ট্রিয়া।

১৯৩৪ বিশ্বকাপে ফেবারিট হিসেবেই যায় অস্ট্রিয়া। সেবারের নকআউট বিশ্বকাপে সহজেই সেমিফাইনালে ওঠে তারা। সেখানে তারা মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইতালির। মুসোলিনি তখন ইতালির ক্ষমতায়। শোনা যায় ইতালির প্রতিটি ম্যাচের আগে রেফারি ঠিক করতেন তিনি নিজে, এমনকি তাদের সাথে ডিনার করতেন। ম্যাচে সিন্ডেলারের উপর মারমুখী হয়ে খেলতে লাগলো ইতালির ডিফেন্ডাররা, অথচ রেফারি ছিলেন নির্বিকার। মিয়াজ্জার একমাত্র গোলে সেদিন হেরে যায় অস্ট্রিয়া।

১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়া দখল করে নেয় জার্মানি। দখল করেই ইহুদীদের ফুটবলীয় সকল কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ করে নাৎসিরা। ব্যাপারটা সিন্ডেলারের মোটেও ভালো লাগেনি। তাকে জার্মান দলের হয়ে খেলবার জন্য প্রস্তাব দেয়া যায়। কিন্তু নিজের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক এমন দলের জার্সি গায়ে জড়াতে অস্বাকৃতি জানান তিনি। কিন্তু নাছোড়বান্দা জার্মানরা অস্ট্রিয়া দখলের বিজয়োৎসব করতে দুই দলের মাঝে এক প্রীতি
ম্যাচের আয়োজন করে।

তবে ম্যাচের আগে জানিয়ে দেয়, ম্যাচের ফলাফল কোনোভাবেই জার্মানির বিপক্ষে যাওয়া চলবে না। গোলশূন্য ড্র হলে সবচেয়ে ভালো হয়।কিন্তু ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডান। দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হতেই সিন্ডেলার ম্যাজিক শুরু হয়, জার্মান ফুটবলাররা তাকে আটকাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এমতাবস্থায় ৭০ মিনিটে গোল করে বসেন সিন্ডেলার। পরে ২-০ গোলে ম্যাচ জিতে নেয় অস্ট্রিয়া। ব্যাপারটি মোটেও ভালো লাগেনি ভিআইপি বক্সে বসে থাকা নাৎসি সেনাদের।

নয় মাস পরের কথা। সিন্ডেলারের বন্ধু গুস্তাভ হার্টম্যান বন্ধুর সাথে দেখা করতে তার ফ্ল্যাটে যান। অনেকবার শব্দ করার পরও দরজা না খোলায়, দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আবিষ্কার করেন সিন্ডেলার
আর তার বান্ধবীর মৃতদেহ। ঘরের হিটার নষ্ট হয়ে বিষাক্ত কার্বন মনো অক্সাইডের কারণে মৃত্যু হয় দু’জনের।

সিন্ডেলারের মৃত্যু কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি জার্মানরা প্রতিশোধ নিয়েছিল? গোল করে নাৎসিদের সামনে উদযাপনই কি কাল হয়েছিল তার জন্য? ইতিহাসের অনেক অমীমাংসিত রহস্যের মতোই ম্যাথিয়াস সিন্ডেলারের মৃত্যু রহস্য তাই রয়ে যাবে অমীমাংসিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link