‘মাহরেজকে দ্রুত বদলি করো, সে আলমাইরনের মত খেলছে।’ – গত মৌসুমে জ্যাক গ্রিলিশ যখন নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের ফুটবলার মিগুয়েল আলমাইরনকে নিয়ে এই তাচ্ছিল্য ভরা মন্তব্য করেন তখন তার কোন জবাব দেননি তিনি হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন মাঠের খেলায় মোক্ষম জবাব দেওয়ার জন্য।
মৌসুমে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ঘরের মাঠ সেন্ট জেমস পার্কে মিগি সেই সুযোগ অবশেষে পেয়ে গেলেন, ম্যাচের ২৮ মিনিটে অ্যালেন সেইন্ট মাক্সিমিনের ক্রস থেকে গোল করে দলকে ১-১ য়ে সমতায় ফেরান তিনি। ইনজুরির কারণে আগেই দল থেকে ছিটকে পরা জ্যাক গ্রিলিশ এদিন মাঠে থাকলে সেই মুহূর্তে গণমাধ্যমের সবকটি ক্যামেরা যে তার দিকে তাক করা থাকত তা অনায়াসে বোঝা যায়।
গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের শেষ ম্যাচে ঘরের মাঠ ইতিহাদে অ্যাস্টন ভিলার কাছে ০-২ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি, পরবর্তীতে ৩-২ গোলে ম্যাচটি জিতে লিগ শিরোপা নিশ্চিত করে তারা। শিরোপা জেতার উৎসব করার সময় সিটির ফুটবলার জ্যাক গ্রিলিশ রিয়াদ মাহরেজের বদলি সম্পর্কে বলতে গিয়ে উক্ত মন্তব্যটি করে বসেন।
তার এই বেফাঁস মন্তব্য নিয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধমে প্রচুর সমালোচনা হয়। ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডে সিটিতে যোগ দেওয়া এই ফুটবলার নিজের দাম অনুযায়ী আগে পারফর্ম করুক এরপর অন্যকে কথা শোনাক এই উপদেশ দেয়া হয় তাকে। আর যাকে নিয়ে এই মন্তব্য করা হয় সেই আলমাইরন এই ব্যাপারে কোন কথাই বলেননি হয়তো সিটির সাথে ম্যাচের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।
নিউক্যাসেল ও ম্যানচেস্টার সিটির মধ্যকার ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ৩-৩ গোলে ড্র হয়। উত্তেজনায় ভরপুর এই ম্যাচে ম্যাগপাইরা একসময় ৩-১ গোলে এগিয়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ড্র নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
ইল্কাই গুন্ডোগানের গোলে ম্যাচের ৫ মিনিটেই ০-১ য়ে এগিয়ে যায় ম্যান সিটি। ম্যাচের ২১ মিনিটের সময় ইনজুরির কারণে সিটির সেন্টার ব্যাক নাথান অ্যাকে মাঠ ত্যাগ করেন, তার বদলি হিসেবে নামেন রুবেন দিয়াজ এরপর ম্যাচের ২৮ মিনিটে আলমাইরন গোল করে নিজ দলকে সমতায় ফেরান।
খেলার প্রথম অর্ধে একের পর এক সুযোগ পেয়েও আর কাজে লাগাতে পারেনি সিটিজেনরা, তাদের খেলায় একটা ছন্ন ছাড়া ভাব ছিল আর অন্যদিকে দুর্দান্ত খেলতে থাকা নিউক্যাসেল ইউনাইটেড নিজেদের সুযোগের সদ ব্যবহার করতে ভুল করেনি। ম্যাচের ৩৯ মিনিটের সময় কাউন্টার অ্যাটাক থেকে গোল করে দলকে ২-১ গোলে এগিয়ে দেন ম্যাগপাইদের স্টাইকার ক্যালাম উইলসন। এ সময় সিটির তিনজন খেলোয়াড় তাকে ঘিরে ফেলেও তার শট আটকাতে ব্যর্থ হয়।
খেলার দ্বিতীয়ার্ধে সিটিজেনরা কিছুটা গুছিয়ে খেলতে শুরু করে, প্রথম অর্ধের মত অগোছালো খেলা বাদ দেয়। এদিকে ম্যাচের ৫৪ মিনিটে ফ্রি কিক থেকে দারুণ এক গোল করেন কিইরান ত্রিপিয়ার, তার এই গোলে নিউক্যাসেল ৩-১ গোলে এগিয়ে যায়। নিয়ার পোস্টে টপ কর্নারে তার নেওয়া শট ঠেকাতে ব্যর্থ হন সিটির গোলরক্ষক এডারসন তবে এরপর থেকে ম্যান সিটি ম্যাগপাইদের টুটি চেপে ধরে।
ম্যাচের ৬০ মিনিটে রডরির থেকে পাওয়া বল মাটিতে পরার আগেই দুর্দান্ত এক শটে তা প্রতিপক্ষের জালে পাঠিয়ে দেন আরলিং হাল্যান্ড, তার ভলি থেকে পাওয়া গোল ম্যান সিটির ম্যাচে ফিরে আসার রাস্তা খুলে দেয়। একের পর এক আক্রমণ করতে থাকা সিটিজেনরা ম্যাচের ৬৪ মিনিটে ডি ব্রুনার এক দারুণ থ্রু বল থেকে বার্নারডো সিলভার গোলে ম্যাচে সমতায় আসে।
বোর্নমাউথ ম্যাচের পর আরলিং হাল্যান্ডের বেশ সমালোচনা হয়েছিল। তবে এদিন তার মুভমেন্টের মাধমে বুঝিয়ে দিলেন প্রিমিয়ার লিগে কেন তিনি সফল হবেন। সিটির তৃতীয় গোল করা বার্নারডো সিলভা যে ফাঁকা হয়ে যান তা মূলত এই স্টাইকারের কল্যাণে, তিনি ডিফেন্ডারদের নিজের দিকে টেনে আনেন ফলে ম্যাগপাই ডিফেন্সে ফাঁটল ধরে আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গোল করেন বার্নারডো সিলভা। হাল্যান্ডের ড্রিবলিং বা মুভেমেন্ট হয়তো আপনার কাছে থিয়েরি অঁরির মত নান্দনিক লাগবে না। তবে তিনি যে এখানে অনেক গোল করবেন এবং তার দলের খেলোয়াড়রা তার কারণে তৈরি হওয়া ডিফেন্সের ফাঁক গোলে প্রচুর গোল করার সুযোগ পাবে তা নি:সন্দেহে বলা যায়।
নিউকাসলের অ্যালেন সেইন্ট ম্যাক্সিমিন ম্যাচ জুড়েই সিটির রক্ষণে নিজের তাণ্ডব দেখিয়েছেন। ফরাসি এই উইঙ্গারকে আটকাতে পারলে নিউক্যাসল হয়তো একটি গোলও করতে পারত না। এডি হাউ গত জানুয়ারিতে ম্যাগপাইদের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর টার্গেট ম্যান জোলিন্টনকে একজন হোলডিং মিডফিল্ডার হিসেবে খেলাতে থাকেন যেখানে এই ব্রাজিলিয়ান নিজের সফলতা পান যা এই ম্যাচেও দেখা গিয়েছে।
৩-১’র লিড শেষ পর্যন্ত রাখতে না পারলেও খেলার দ্বিতীয়ার্ধে ম্যান সিটি যেভাবে আক্রমণ করছিল তা রুখে দিয়ে একটি পয়েন্ট পাওয়ার জন্য প্রশংসার দাবিদার ম্যাগপাইদের ডিফেন্স। ঘরের মাঠে তাদের হারানো যে কতোটা কঠিন হবে তা এই ম্যাচ দেখলেই বোঝা যায়, সেন্ট জেমসেস পার্ককে যে তারা নিজেদের দুর্গ হিসেবে তৈরি করছে প্রিমিয়ার লিগের বাকি দলগুলোকে সেই বার্তাই তারা দিল।
ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে ম্যান সিটির ম্যানেজার পেপ গার্দিওলা প্রিমিয়ার লিগ এবং নিজ দলের জয়গান গেয়েছেন, তিনি বলেন, ‘এই রকম ম্যাচ দেখলে আপনি বুঝতে পারবেন প্রিমিয়ার লিগ কতটা কঠিন, একই সাথে অনুধাবন করতে পারবেন গত পাঁচ বছর ধরে লিগে সফল হতে আমাদের কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয়েছে এবং সামনেও একই সাফল্য পেতে হলে কি পরিমাণ পরিশ্রম করতে হবে। দ্বিতীয়ার্ধে আমরা সেরা দল ছিলাম তাই ৩-১ গোলে পিছিয়ে পরেও আমরা ফিরে আসতে পারি।’
প্রতিপক্ষ নিউক্যাসল সম্পর্কে এই স্প্যানিশ ম্যানেজার বলেন ‘নিউক্যাসল প্রতিভা সম্পন্ন একটি দল এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা মোটেও সহজ নয়।’
৩-১ য়ে এগিয়ে ম্যাচ ড্র করে শেষ পর্যন্ত এক পয়েন্ট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে নিউক্যাসল ইউনআইটেড ম্যানেজার এডি হাউকে। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন ‘সিটির বিপক্ষে আমরা ম্যাচ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে ০-১ গোলে পিছিয়ে পড়ি যা মোটেও ভাল কোন খবর না তবে আমাদের খেলোয়াড়রা এরপর দুর্দান্ত খেলেছে। আমরা তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করতে চেয়েছিলাম এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ একটি ম্যাচ উপহার দিতে চেয়েছিলাম আর এই ক্ষেত্রে আমরা সফল, এটি উত্তেজনায় ভরপুর অসাধারণ একটি ম্যাচ ছিল।’
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই দুই ফুটবল ক্লাবের টান টান উত্তেজনাপূর্ণ খেলা দেখে দর্শক সমর্থক সকলেই খুশি। প্রিমিয়ার লিগের ৩০তম জন্মদিনের এই মাসে ইপিএলের চেয়ে ভাল বিজ্ঞাপন আর কি হতে পারে।