বাংলায় জনপ্রিয় একটা প্রবাদ আছে, যেই লাউ সেই কদু। বাংলাদেশের দলের বর্তমান অবস্থার দরুণে সেই প্রবাদটা এখন খুব চলনসই। পরিবর্তনের বুলি আওড়িয়ে এশিয়া কাপ মিশনে যাওয়া দলটাকে এখন টানা দুই ম্যাচ হেরে দেশে ফিরতে হচ্ছে রিক্ত হস্তে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের নবজাগরণের যে রব উঠেছিল তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় নি মাঠের ক্রিকেটে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যাটিং ইনটেন্টে যে টুকু আশার প্রাণ সঞ্চার হয়েছিল তা মিইয়ে যায় ব্রেইনলেস বোলিংয়ে। বাংলাদেশ দল তাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এখনো এক পাহাড়সম হতাশার নাম।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সমস্যা কোথায় তা নিয়ে খেরোখাতা হয়েছে অনেক৷ সমাধান নিয়েও কম কথা হয়নি। কিন্তু হয়নি যেটা সেটা হলো মানসিকতার পরিবর্তন আর দল কেন ব্যর্থতার বৃত্তবন্দীতে ঘুরছে সেটা নিয়ে।
সাম্প্রতিক সময়ে লিটন দাশ এক সাক্ষাৎকারে বললেন, বলে বলে রান করার মতো ব্যাটার আমাদের আছে, কিন্তু ১৪০/১৫০ স্ট্রাইকরেটে ব্যাট করার মতো কোনো ব্যাটার নেই। এজন্য আমাদের সামর্থ্য সর্বোচ্চ ১৬০/১৬৫।
লিটন দাশের কথায় দলের সীমাবদ্ধতা নিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি। কথার মাঝে অসহায় আত্মসমর্পণ আছে কিনা সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু প্রশ্ন হল, সীমাবদ্ধতা আছে জেনেই কি হাল ছেড়ে দেওয়া উচিত? নাকি সেটি নিয়ে কাজ করা উচিত? মানসিক দৃঢ়তায় এখানেই পিছিয়ে বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা।
এক তরফা ক্রিকেটারদের দোষ দিয়েই বা কী লাভ? টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট প্রস্তুতির জন্য আমাদের একমাত্র মঞ্চ বিপিএল। বিপিএল কেমন দায়সারা ভাবে শেষ করা হয় সেটি প্রায় সবারই জানা। আদৌতে পুরো বিপিএল এর কোনো একটি আসর টি-টোয়েন্টি সুলভ পিচে হয়েছে কিনা সন্দেহ। এর কারণে যা হওয়ার তাইই হয়েছে। বাংলাদেশি ব্যাটাররা রক্ষণাত্বক খোলস থেকে বের হতে পারেনি।
এমনকি মন্থর পিচে বেশিরভাগ খেলানোয় হাই স্কোরিং ম্যাচের স্বাদ পাওয়া গেছে কম। ব্যাটার, বোলারদের একই মুহূর্তে প্রেশার মোমেন্ট হ্যান্ডেল করার চিত্রও তেমন দেখা যায়নি। যেখানে আইপিএল, বিগ ব্যাশ, পিএসএলে ম্যাচের পর ম্যাচে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের থ্রিলিং টের পাওয়া যায়। এমন পরিস্থিতির অনভ্যস্তাতে তাই প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের তীরে এসে তরী ডুবানোর ঘটনায় যেন অনুমিত হয়ে গেছে।
সমস্যার আরেকটা নাম ব্যক্তিপূজা। ব্যক্তিপূজায় জর্জরিত বর্তমান বাংলাদেশ দল। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট ইয়াং ব্লাডদের খেলা। এখানে ব্যাটিং, বোলিং যেমন গুরুত্বপূর্ণ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফিল্ডিংও। একটা দুর্দান্ত ক্যাচ কিংবা রানআউট ম্যাচের মোমেন্টাম ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই মুহূর্তে টি-টোয়েন্টি দলে সাকিব, মুশফিক, রিয়াদই সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার। সমস্যা হলো, বাংলাদেশ দলে এই ব্যক্তিপূজার কারণেই দলে থাকা তরুণ ক্রিকেটাদের পিক টাইম বলি দিতে হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের কথায় ধরা যাক। সাকিব, মুশফিক, রিয়াদ-তিনজন মিলে বল খেলেছেন ৪৯ টা, রান করেছেন ৫৫। যেখানে বাকি ৭১ বলে মিরাজ, সাব্বির, আফিফ, মোসাদ্দেক, তাসকিন মিলে করেছে ১২৮ রান। স্পষ্ট ব্যবধান। অথচ দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটিং পজিশনগুলো এখনো টিকে আছে সিনিয়রদের দৌরাত্মে।
গত ম্যাচে ৪ রানের মাধ্যমে মুশফিক তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ১৫০০ রানের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। এ মাইলফলক স্পর্শ করতে তিনি ম্যাচ খেলেছেন ১০২ টা। টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটে ১৫০০ রান পূরণ করতে তার চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেননি আর কোনো ব্যাটার। আরো একটা ফ্যাক্ট উল্লেখ করা উচিত, ১৫০০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে মুশফিকের স্ট্রাইকরেটই সবচেয়ে কম।
দলের চার নম্বরে নিয়মিত ব্যাট করা একজন ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাঁক খাচ্ছে। অথচ তার রিপ্লেসমেন্ট খোঁজা বা তৈরি করার সামান্য প্রয়াসটুকুও নেই। কারণ সেই অকাট্য যুক্তি, মুশফিক টেস্ট আর ওয়ানডেতে আমাদের অন্যতম সেরা ব্যাটার। ফরম্যাট ভেদে অনেক সেরা ক্রিকেটারকে যে ছেঁটে ফেলার উদাহরণ আছে তা বোধহয় বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে অজানা।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ অনেকদিন ধরেই ব্যাটিংয়ের শুরুতে রান বের করতে বেগ পাচ্ছেন। উইকেটে এসে সেট হচ্ছেন। কিছু সিঙ্গেল টানছেন। শেষ মুহূর্তে কয়েকটা বাউন্ডারি মেরে কিছুটা রান করছেন। কিন্তু সেই ইনিংসটা আর বড় করতে পারছেন না। ফলত তার সেই ইনিংসটা বাংলাদেশের জন্য শেষ পর্যন্ত গলার কাঁটায় হয়ে দাঁড়ায়। এখানেই শেষ নয়, শেষ ১ বছরে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর স্ট্রাইক রেট কোনোমতে ১০০ ছাড়িয়েছে। মিডল অর্ডারে খেলা এক ব্যাটার ম্যাচের পর ম্যাচ স্ট্রাগল করছেন। অথচ ‘নির্ভরযোগ্য’, ‘সাইলেন্ট কিলার’ তকমায় বহাল তবিয়তে দলে টিকে আছেন।
বোলিং লাইনআপে আস্থার এক নাম ছিল মুস্তাফিজ। আইপিএল খেলার অভিজ্ঞতাসহ বোলিং ভেরিয়েশনে অন্যান্য পেসারদের চেয়ে মুস্তাফিজ একটু আলাদায় ছিলেন। কিন্তু পুরনো সেই মুস্তাফিজ এখন প্রায় অতীত হতে বসেছে। একজন বোলারের শুরুর চমক ধরে রাখার জন্য নিয়মিত কাজ করে যেতে হয়। বোলিংয়ে নতুন ইনোভেশন আনতে হয়। মুস্তাফিজের ব্যাপারে এই একই কথা বলেছেন পাকিস্তান গ্রেট ওয়াসিম আকরাম।
তিনি বলেন, ‘ক্রিকেট এখন পরিবর্তন হয়েছে। নতুন-নতুন বিষয় শিখতে হবে, উন্নতি করতে হবে। তাকে অবশ্যই ইনসুইং শিখতে হবে। বলের বৈচিত্র বাড়াতে হবে। শুরুতে তার যে ধার ছিল এখন সেটা অনেকে বুঝে ফেলেছে, ব্যাটসম্যানরা এসব দেখে বোলারের কারিশমা আবিষ্কার করে ফেলে। যত দ্রুত সে এটা আয়ত্ত করতে পারবে তার জন্যই ভালো হবে।’
মুস্তাফিজ নিজে সেটা কতটুকু করেন তা অজানা। করলেও তার প্রতিফলন মাঠে দেখা যায় সামান্যই। মিরপুরের বাইরে মুস্তাফিজ তাই আর কটা সাধারণ বোলারের মতোই এখন পারফর্ম করেন। এটা যতটা না তার নিজের জন্য হতাশার তারচেয়ে বেশি হতাশাজনক বাংলাদেশ দলের জন্য।
দলের প্রায় সবারই ৫/৬ বছর আন্তর্জাতিক সার্কিটে খেলার অভিজ্ঞতা। তারপরও কেন বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়? মোদ্দা কথা হলো, সেই অভিজ্ঞতা আসলে কতটা কাজে লাগানোর জন্য যথেষ্ট? টি-টোয়েন্টি ম্যাচ জেতার জন্য ৫০ টা ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতার চেয়ে ১০ টা ম্যাচ জয়ে অবদান রাখার অভিজ্ঞতাটা জরুরী। বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের সেই অভিজ্ঞতাটায় কম।
প্রতিবার নির্দিষ্ট কোনো টুর্নামেন্ট বা সিরিজকে সামনে রেখে ব্যাটিং কোচ জেমি সিডন্সকে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাটারদের নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। এটা খুবই ভাল ব্যাপার। অন্তত কোচ দলের ব্যাটারদের নিয়ে সচেতন আছেন। এই যেমন এশিয়া কাপ শুরুর আগে পাওয়ার হিটিং নিয়ে মিরাজ, এনামু্লদের নিয়ে কাজ করলেন। এটা ভাল ব্যাপার। তবে ঐসব ভিডিওতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ঘরোয়া ক্রিকেটে পাওয়ার হিটিং নিয়ে কাজ হয় খুবই কম কিংবা ক্রিকেটাররা নিজেদের তাগিদে সদিচ্ছায় সেটি নিয়ে কাজ করে কম।
এসব কিছুর অভিযোগ অবশ্য একদিকেই যায়। বিসিবি টি-টোয়েন্টি নিয়ে এতো উদ্বিগ্ন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের টি-টোয়েন্টি লিগ করার ব্যাপারে তাদের প্রচেষ্টাটা কোথায়? কথা আর কাজের মধ্যে এত গরমিল হলে মাঠের বাংলাদেশও তথৈবচ থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক।
বাকি দুই ফরম্যাট এক পাশে রাখলে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট বাংলাদেশের জন্য সত্যিই একটা ব্যর্থতার নাম। সে ব্যর্থতা সহসাই কেটে যাবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবে ক্ষীণ সম্ভাবনা দেখে পিছু হাঁটলে যে তিমিরে আবদ্ধ ছিলো এতদিন, সেই তিমিরেই আটকে থাকবে বাংলাদেশ।