মহাদেশীয় ক্রিকেট সংস্কৃতির বিবেচনায় স্পিন বোলিংয়ের আতুঁড় ঘর বলা যায় এশিয়া মহাদেশকে। সেটা একটু ছোট করে এনে দক্ষিণ এশিয়া বললে অবশ্য ভুল হয় না। বর্তমান কিংবা অতীত, যুগের পর যুগ দারুণ সব স্পিনার এসেছে এই উপমহাদেশ থেকেই। সে সব স্পিনারের নাম করা শুরু করলে শেষ হতে হতে লম্বা এক তালিকা দৃশ্যমান হতে পারে।
বর্তমানে রশিদ খান, মুজিব উর রহমান থেকে শুরু করে রবিচন্দ্রন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাদেজা, শাদাব খান, সন্দ্বীপ লামিছানে, বাংলাদেশের সাকিব আল হাসান, মেহেদী হাসান মিরাজ সহ আরো এক ঝাঁক স্পিনারের নাম উঠে আসবে এই তালিকায়। কিংবদন্তি স্পিনারদের কথা তুললেও সর্বকালের সেরা তিন স্পিনারদের মধ্যে দুটি নাম দক্ষিণ এশিয়া থেকেই ভেসে ওঠে। একজন মুত্তিয়া মুরালিধরন, আরেকজন অনিল কুম্বলে।
স্পিনার সমৃদ্ধ দেশ। তাই স্পিনারদের জন্য বাড়তি সুবিধাও থাকে দক্ষিণ এশিয়ার পিচ গুলোতে। এ কারণে বাইরের দেশগুলোও ভারত, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশ সফর করার সময় বাড়তি স্পিনার দলে নিয়েই আসেন। সেটা দলের স্পিন আক্রমণ বাড়ানোর পরিকল্পনাতেও হয় আবার প্রতিপক্ষ দলের স্পিন আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতির উদ্দেশ্যেও হয়ে থাকে।
স্বাভাবিকভাবেই এশিয়ার ক্রিকেটারদের স্পিনারদের বিপক্ষে ভাল খেলার কথা। কারণ এ অঞ্চলের বেশিরভাগ ক্রিকেটারই সেসব পিচে খেলে অভ্যস্ত যেখানে স্পিন ধরে বেশি। বছরের পর বছর এমন সব পিচে খেলায় স্পিনারদের জন্য মহাত্রাস হওয়ার কথা তাদের। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এ দলগুলোর ব্যাটারদের সক্ষমতায় উঠে এলো উল্টো চিত্র। এশিয়ার ব্যাটাররা নাকি স্পিনের চেয়ে পেস বোলিং টাই ভাল খেলেন!
২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে দেখা যাচ্ছে, আফগান ব্যাটাররা যেখানে পেসারদের বিপক্ষে ১৩১.৭১ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছে সেখানে স্পিনারদের বিপক্ষে তাদের স্ট্রাইক রেট ১০৪.৩২। লঙ্কানদের ক্ষেত্রে আবার এই সংখ্যাটা আরো কম। পেসারদের বিপক্ষে তাদের স্ট্রাইক রেট ১২০.৬৬, স্পিনারদের বিপক্ষে সংখ্যাটা ১০৩.৫৮।
বাংলাদেশ অবশ্য স্পিনারদের বিপক্ষে দ্রুত রান করার দিক দিয়ে এ দুই দেশের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে। তারা স্পিন বোলারদের সামলেছেন ১০৭.১৪ স্ট্রাইক রেটে। তবে সেই সাথে পেসারদের বিপক্ষে আবার তাদের দৈন্যদশা ফুঁটে ওঠে। এশিয়ার দলগুলোর মধ্যে পেসারদের বিপক্ষে সবচেয়ে কম স্ট্রাইক রেট বাংলাদেশি ব্যাটারদের, ১১৭.৫৮।
পেসারদের বিপক্ষে পাকিস্তানের স্ট্রাইকরেট ১৪১.৭১ হলেও স্পিনের বিপক্ষে সংখ্যাটা ১১২.৪১। এ তিন দলের মাঝে ভারতই একটু ব্যালান্স স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছে। পেসারদের বিপক্ষে তাদের স্ট্রাইক রেট ১৪৪.৯২, স্পিনারদের বিপক্ষে সেটা ১৩৫.৯৭। অর্থাৎ এ ৪ দলেরই তুলনামূলক স্পিন বোলারদের বিপক্ষে রান করতে স্ট্রাগল করার চিত্রটা প্রতীয়মান।
টপ অর্ডারে ব্যাট করা ক্রিকেটারদের পরিসংখ্যান ঘাটলেও এই স্পষ্ট ব্যবধানটা চোখে পড়ে। পাকিস্তানের টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান ফখর জামানের পেসারদের বিপক্ষে যেখানে ১৩০ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করেছেন সেখানে স্পিনারদের বিপক্ষে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১০০ এর কিছু বেশি, ১০৫!
একই সমস্যা ভারতের রোহিত শর্মা আর কে রাহুলেরও। কে এল রাহুল পেসারদের বিপক্ষে ১২৬ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করলেও স্পিনারদের বিপক্ষে তার স্ট্রাইক রেটটা খুবই দৃষ্টিকটু। মাত্র ৮৬! রোহিত শর্মার ক্ষেত্রেও চিত্রটা অনেকটা এমনই। পেসারদের বিপক্ষে ১৫৬ স্ট্রাইক রেট কিন্তু স্পিনারদের বিপক্ষে সেটা ১১৭!
স্পিনিং কন্ডিশনে বেড়ে উঠেছে অথচ সেই স্পিনারদের বিপক্ষেই কেন এশিয়ার ব্যাটারদের এই ভগ্নদশা? শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তানকে ভিন্ন সময়ে কোচিং করানো মিকি আর্থার মনে করেন, স্পিনারদের বিপক্ষে এ অঞ্চলের ব্যাটারদের রিস্কি শট খেলার প্রবণতা কম। টপ ব্যাটারদের কাছে সুইপ কিংবা রিভার্স সুইপ শট খেলার চিত্র দেখা যায় না বললেই চলে। সুইপ, রিভার্স সুইপ শট কাভার ড্রাইভের মতো ন্যাচারাল স্ট্রোক না।
এটার জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। নাহলে শট অ্যাকুরেসি ঠিক থাকে না। কিন্তু এশিয়ার ক্রিকেটাররা রান করার করার জন্য শুধু কব্জির উপরেই জোর দেন। কিন্তু কৌশলগতভাবেই স্পিনারদের বিপক্ষে রান বের করা যায়। সে চেষ্টার দেখা খুব একটা মেলে না। বরং তারা স্পিনারদের বিপক্ষে রয়ে শয়ে খেলতে পছন্দ করে। এজন্য নির্দিষ্ট করে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে ভারত, পাকিস্তানের ব্যাটাররা স্পিনারদের বিপক্ষে খুব বেশি চড়াও হতে পারেন না।
মিকি আর্থারের ভাবনায় অবশ্য ভুল কিছু নেই। ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাবর আজম ২ বার আর বিরাট কোহলি তিনবার সুইপ শট খেলার চেষ্টা করেছেন। ঠিক সেই জায়গাতেই ভিন্ন উদাহরণ তৈরি করেছেন সুরিয়াকুমার যাদব আর দিনেশ কার্তিক। স্পিনারদের বিপক্ষে ২৪ বার সুইপ শট খেলেছেন সুরিয়াকুমার আর ২০ বার এই শটটি খেলেছেন দীনেশ কার্তিক।
সুরিয়াকুমার সুইপ, রিভার্স সুইপ খেলা সেই ২৪ টি বলে করেছেন ৫৬ আর দিনেশ কার্তিক করেছেন ২০ বলে ৩৬ রান। অর্থাৎ এক সুইপ শটেই তারা এমন ব্যবধান তৈরি করেছেন। তাই বোলিং ভ্যারিয়েশন নামে যে টার্মটা সাম্প্রতিক কালে খুব শোনা যায় সে ধরনের বৈচিত্র্যতা ব্যাটারদেরও শট সিলেকশনে আনা উচিত।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মোমেন্টামের খেলা। অনেকটা সমাপ্তি থাকা ছোট গল্পের মতো। অল্প সময়েই দারুণ কিছু করে দেখানোর মঞ্চ। একজন বোলার প্রতিনিয়ত যেমন তাঁর বোলিংয়ের বিভিন্ন ভ্যারিয়েশন নিয়ে কাজ করেন ঠিক তেমন ভাবেই একজন ব্যাটারেরও তাঁর ব্যাটিংয়ে বিভিন্ন শটের রসদ যোগ করা উচিত। শট সিলেকশনে নতুনত্বতা আনা উচিত। অন্যথায় ওয়ান ডাইমেনশনাল ব্যাটার হয়েই তাকে খেলে যেতে হবে। আর সামনের সময়ে এমন ওয়ান ডাইমেনশনালদের জন্য টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা হবে আরো কঠিন।