পাকিস্তানের মত করে জিতল পাকিস্তান

পাকিস্তান ক্রিকেটের সাথে ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ ট্যাগ জুড়ে দেয়া হয়েছে অনেক আগে। আর এই ট্যাগ জুড়ে দেয়ার যথার্থতা বারবার প্রমাণ করেছে দলটি। কখনো প্রায় নিশ্চিত পরাজয়ের ম্যাচে তুলে নিয়েছে জয়, কখনো আবার জিততে জিততে মাঠ ছেড়েছে বেদানাকে সঙ্গী করে। সর্বশেষ আফগানিস্তান বিপক্ষে আরো একবার পাকিস্তান বুঝিয়ে দিলো কেন তারা ক্রিকেটের মাঠে অননুমেয়।

আপনি যখন ভাবছেন পাকিস্তান ম্যাচে পিছিয়ে গিয়েছে তখনই তারা ফিরেছে স্বরূপে। যখন ভেবেছেন পাকিস্তান এই ম্যাচ হারতে যাচ্ছে, তখনই তারা জিতেছে। শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান আসিফ আলী যখন ব্যাট প্যাড গুছিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন ড্রেসিং রুমের দিকে, জয় থেকে তখনও পাকিস্তান ১২ রান দূরে; হাতে এক উইকেট। দেশটির সবচেয়ে বড় আশাবাদী ভক্তও হয়তো তখন জয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছিল।

ভক্ত-সমর্থকরা যখন পরাজয় মেনে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়েছেন নাসিম শাহ। ফাস্ট বোলার নাসিম শাহ এর পারফরম্যান্সে ভরসা থাকলেও ব্যাটার নাসিমের ভরসা করবে এমন কেউ বোধহয় ছিল না। আর তিনিই কি-না তরুণ আফগান পেসার ফজল হক ফারুকির দুই বলে দুইটি বিশাল ছয় হাঁকিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করেছেন।

পেন্ডুলামের মতে দুলতে থাকা ম্যাচে পাকিস্তানের জয়ের নায়ক ১৯ বছর বয়সী এক পেসার। আফগানিস্তানকে স্তব্ধ করে দিয়ে দলকে ভিড়িয়েছেন জয়ের বন্দরে। আশাতীত ভাবে নাসিম শাহদের এমন জয় দেখে বলতেই হয়, পাকিস্তান মূলত জিতেছে পাকিস্তানের মত করেই।

২০১৮ সালের এশিয়া কাপ, ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০২২ সালের এশিয়া কাপ – বড় মঞ্চে আফগানিস্তানের হাতের মুঠো থেকে ম্যাচ ছিনিয়ে নেয়া অভ্যাসে পরিণত করেছে পাকিস্তান। দলটির বিপক্ষে নিজেদের দুর্ভাগা ভাবতেই পারেন রশিদ খান, মুজিবুর রহমানরা।

জিতলেই ফাইনাল এমন সমীকরণকে সামনে রেখে পাকিস্তান যখন টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখনই জয়ের পাল্লা ভারী হয়েছিল বাবর আজমদের দিকে। কিন্তু ছন্নছাড়া বোলিংয়ে পাওয়ার প্লেতে দুই হাতে রান বিলিয়েছে পাক পেসাররা। ম্যাচের রং বদলাতেও সময় লাগে; শাদাব খান আর মোহাম্মদ নওয়াজের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের আফগানদের রান তোলার গতিতে ভাটা পড়েছিল।

শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত বিশ ওভারে ছয় উইকেট হারিয়ে আফগানিস্তান সংগ্রহ করেছিল মাত্র ১২৯ রান। সময়ের সেরা টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান সমৃদ্ধ ব্যাটিং লাইনআপ পাকিস্তানের, এই লক্ষ্য তাড়া করা তখন সময়ের ব্যাপার মনে হয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। কিন্তু মাঠে নামতেই দেখা যায় ভিন্ন এক দলকে।

সদ্যই টি-টোয়েন্টি র‍্যাংকিংয়ের এক নম্বর পজিশন হারানো বাবর আজম ফিরে যান গোল্ডেন ডাক মেরে। ফখর জামানও কাটা পড়েন রান আউটে। এরপর রিজওয়ান এবং খুশদিল শাহের ধীরগতির ব্যাটিং পাকিস্তানের উইকেট বাঁচালেও ম্যাচকে ঠেলে দিয়েছে রোমাঞ্চের দিকে। মিডল অর্ডারে শাদাব খানের ২৬ বলে ৩৬ রানের ইনিংস পাকিস্তানকে ভালোভাবেই জয়ের পথে রেখেছিল।

সাত ওভারে ৫১ রান প্রয়োজন – জয় তখনও হাতের কাছেই ছিল পাকিস্তানের। কিন্তু আনপ্রেডিক্টেবল দলটির এমন সহজ জয় বোধহয় পছন্দসই ছিল না। হঠাৎই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে ব্যাটিং লাইনআপ, আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পায় আস্কিং রান রেট।

শেষ দুই ওভারে পাকিস্তানের দরকার ছিল ২১ রান। ক্রিজে ছিলেন আসিফ আলী, ছয় মারার জন্য সুখ্যাতি পাওয়া এই ফিনিশারের কাঁধে ভর করে জেতার স্বপ্ন দেখেছিল পাকিস্তান। কিন্তু দিনের সেরা বোলার ফরিদ মালিকের বাউন্সারে আটকা পড়লে নিভে যায় আশার প্রদীপ।

এরপরের গল্প জানা হয়ে গিয়েছে সবারই। বোলার থেকে ব্যাটার বনে যাওয়া নাসিম শাহ হয়ে উঠেছিলেন কার্লোস ব্রাথওয়েট। ২০১৬ সালে ইডেন গার্ডেনে যেমন অবিশ্বাস্য ব্যাটিং করেছিলেন উইন্ডিজ তারকা, তেমন কিছুই আরো একবার দেখালেন নাসিম শাহ। কি জানি, যেভাবে অনায়াসে বলগুলোকে বাউন্ডারি ছাড়া করেছেন তিনি, শেষ ওভারে আরো এক দুইটি ছয় প্রয়োজন হলেও হয়তো তুলে নিতেন পেশওয়ারের এই ক্রিকেটার।

নেভিল কার্ডাসের ক্রিকেটে আগে থেকে কিছু অনুমান করাটা বেশ কঠিন। সেই কঠিন কাজটা রীতিমতো দুঃসাধ্যের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে পাকিস্তান। ইমরান খানের অধীনে বিশ্বকাপ জয়, সরফরাজের অধীনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জয় কিংবা আফগানিস্তানের বিপক্ষে এই শ্বাসরুদ্ধকর জয় – সবকিছু পাকিস্তানের আনপ্রেডিক্টেবল হয়ে উঠার গল্পের এক একটি সাক্ষী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link