যুব বিশ্বকাপ খেলার আগে জাতীয় দলের খেলেছেন এমন ক্রিকেটারের সংখ্যাটা মাত্র পাঁচ। পাঁচ জনের একজন এনামুল হক জুনিয়র। মাত্র ষোলো বছর বয়সে বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে অভিষেক হয় তাঁর। বাকি চারজন হলেন – মুশফিকুর রহিম, জর্জ ডকরেল, টাটেন্ডা টাইবু, টিম সাউদি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর প্রথম বার টেস্ট খেলতে দেশে আসছে ইংল্যান্ড। তার আগে খেলা টেস্টে ম্যাচ গুলোতে হারের বিপরীতে জয় শুন্য ছিল বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে নবীন সদস্য বাংলাদেশ, খেলতে যাচ্ছে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এদিকে মোহাম্মদ রফিকের সাথে দ্বিতীয় বাঁ-হাতি স্পিনার খুঁজছে বাংলাদেশ। কোচ, নির্বাচক, অধিনায়ক ভাবছিলেন কাকে নেওয়া যায় তার সাথে তা নিয়ে চলছে বিস্তর গবেষণা, খুঁজাখুঁজি শুরু হল। তখনই নাম চলে আসে এনামুল হক জুনিয়রের।
মোহাম্মদ রফিকের যোগ্য সঙ্গী হতে পারেন কিনা তা যাচাই করার জন্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে বিসিবি একাদশের হয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হল এনামুল হক জুনিয়রকে। প্রস্তুতি ম্যাচে বা হাতের স্পিন ঘূর্ণিতে নিজের জাত চেনালেন জুনিয়র। সেই সাথে নির্বাচকদের আস্থার প্রতিদানও দিলেন তিনি। প্রস্তুতি ম্যাচে তুলে নিলেন চার উইকেট। প্রস্তুতি ম্যাচে দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেটে নিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ার আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে গেলেন তিনি। ব্রিটিশ মিডিয়া তাঁর বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলে, তাদের জুনিয়রের বয়সটা নাকি কিছুটা বেশি। তাদের ধারণা এত কম বয়সে টেস্ট অভিষেক হতে যাওয়া এই তরুণের বয়সে নাকি কারচুপি করা হয়েছে। তারা প্রশ্ন তুলেছিল বয়স লুকিয়ে তাঁকে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক করাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এমন সমালোচনার জবাবটা কিন্তু বল হাতে মাঠেই দিয়েছিলেন ষোলো বছর বয়সী এই কিশোর।
প্রস্তুতি ম্যাচে বল হাতে তাঁর আলোকিত পারফর্মেন্সে মুগ্ধ হয়ে যান তখনকার অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ সুজন। সুজন কোচ এবং নির্বাচকদের গিয়ে বললেন রফিকের পার্টনার হিসাবে তাঁকে নেওয়া যায়। সে সময় অধিনায়কের কথায় আস্থা রেখেই নির্বাচক এবং কোচ তাঁকে দলে নিলেন। তখনকার কোচ ডেভ হোয়াইটমোর বেশ খুশি নির্বাচকদের এমন সিদ্ধান্তে। এনামুল হক জুনিয়রের মাঝে তিনি আগামীর মোহাম্মদ রফিকের ছায়া দেখছেন তিনি।
২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণ টেস্টে অভিষেক হয় এনামুল হক জুনিয়রের। প্রস্তুতি ম্যাচের মত নিজের প্রথম টেস্টেও এনামুল হক জুনিয়র সমান উজ্জ্বল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে নিলেন দুই উইকেট। সাজঘরে পাঠালেন সেই ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান ট্রেসকতিককে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৭ ওভার বল করে ছিলেন উইকেট শুন্য। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে পেয়েছিলেন দুই উইকেট।
জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট খেলা হয়ে গেছে যুব বিশ্বকাপের আগে। কারণ বয়সটা যে ছিল খুবই কম, তখন সতেরোর কাছাকাছি আর যুব বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালে। বাংলাদেশ অনুষ্ঠিত হয় সে বিশ্বকাপ, বাংলাদেশের দলে খেলেন এনামুল হক জুনিয়র। বল হাতে বাজিমাত করেন এনাম, ৮ ম্যাচে তাঁর ঝুলিতে ২২ উইকেট। যা এখনো বাংলাদেশী কোনো বোলারের সর্বোচ্চ। যুব বিশ্বকাপে প্লেট ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নেন পাঁচ উইকেট। তাঁর এই অবিশ্বাস্য বোলিং নৈপুণ্যে প্লেট ফাইনালে বাংলাদেশ অস্টেলিয়াকে হারায় নয় রানে। এই বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর স্বীকার ছিল সাত উইকেট। তাঁর এমন পারফর্মেন্সে আবারও জাতীয় দলে সুযোগ পান জুনিয়র।
২০০৫ সালে জাতীয় দলের হয়ে সেরা সাফল্য পান এনামুল হক জুনিয়র। সে বছর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। আর সেই ম্যাচে বল হাতে জয়ের নায়ক এনামুল হক জুনিয়র। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্টে কিছুটা নার্ভাস ছিলেন এনামুল হক জুনিয়র। কারণটা ছিল বাংলাদেশের হয়ে খেলা আগের টেস্ট গুলোতে তেমন বড় কোনো সাফল্য পাননি তিনি। আর এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ছিলেন উইকেট শুন্য, তাই মনোবলটা ছিল একটু নড়বড়ে। এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট পাওয়া স্পিনার মোহাম্মদ রফিক পড়েন ইনজুরিতে, দ্বিতীয় ইনিংসে বল করতে পারবেন না।
দ্বিতীয় ইনিংসে অধিনায়ক হাবিবুল বাশার এনামুল হক জুনিয়রকে বললেন, ‘এই ম্যাচ জিততে বল হাতে তকে নেতৃত্ব, রফিক বল করতে পারবে না।’ তখন অধিনায়কের এমন কথায় আকাশটা ভেঙে যেন তাঁর মাথায় পড়ল। এক তো প্রথম ইনিংসে ছিলেন উইকেট শুন্য, দ্বিতীয় তো মোহাম্মদ রফিক বল করতে পারছেন না। স্পিন বোলিংয়ের দায়িত্বটা তাকে সামলাতে হবে। তাই কিছুটা চাপ এসে পড়ে।
এমন অবস্থায় তাঁর মনে শক্তির সঞ্চার দিলেন সতীর্থ আফতাব, রাজিনরা। তাঁকে বুঝালেন ভয় পাওয়ার কিছু নাই, শুধু জায়গা মতো বল করে যা, উইকেট পাবি। অধিনায়ক আর সতীর্থদের উৎসাহে সেদিন বল হাতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এনামুল হক জুনিয়র। দ্বিতীয় ইনিংসের ১৭তম ওভারে প্রথম উইকেটের দেখা পান এনাম, ক্লিন বোল্ডে সাজঘরে পাঠান জিম্বাবুয়ের ওপেনার স্টুয়ার্ট মাৎসকেনেরিকে।
আর তাতেই তিনি সাহস ফিরে পান, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং বুঝতে পারলেন আসলে তিনি পারবেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তিনি অসাধারণ বোলিং করেছিলেন, পেয়েছিলেন ছয় উইকেট। তাঁর এই অবিশ্বাস্য বোলিং পারফর্মেন্স প্রথম টেস্ট জয় পায় বাংলাদেশ। দ্বিতীয় ইনিংসে ছয় উইকেট নিয়ে তিনিই বাংলাদেশের জয়ের নায়ক। সেদিন জয়ের আনন্দে ভাসান বাংলাদেশ ক্রিকেট পাগল মানুষকে। ক্রিকেটারদের পাশাপাশি গ্যালারি ভর্তি দর্শক নেচে-গেয়ে মেতে ওঠেন প্রথম টেস্ট জয়ের উল্লাসে।
প্রথম টেস্টের এই সাফল্য দ্বিতীয় টেস্টেও টেনে নেন জুনিয়র। এই ম্যাচে আরো এক ধাপ এগিয়ে যান, প্রথম বাংলাদেশী বোলার হিসেবে টেস্টে এক ইনিংসে সাত উইকেট লাভ করেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই ম্যাচে ৯৫ রানে ৭ উইকেট পান তিনি। এই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও পান পাঁচ উইকেটের দেখা। এক ম্যাচে পান ১২ উইকেট। বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ বোলার হিসেবে এক ম্যাচে ১২ উইকেট লাভ এনামুল হক জুনিয়র। বল হাতে এই সাফল্যে তিনি পেছনে ফেলেন পাকিস্তান গ্রেট ওয়াসিম আকরামকে।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই ম্যাচের টেস্ট ১৭ উইকেট নিয়ে প্রথম টেস্ট জয়ের নায়কের পাশাপাশি প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের নায়কও বনে যান এনাম। সাদা পোশাকে বাংলাদেশের হয়ে ২০০৩ সালে অভিষেক হলেও লাল সবুজের জার্সিতে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় ২০০৫ সালে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে অভিষেক হয় তাঁর। প্রথম ম্যাচেই দুই উইকেট লাভ করেন। এই সিরিজে তিন ওয়ানডে খেলে উইকেট পান চারটি।
টেস্ট যতটা না বল হাতে ছিলেন উজ্জ্বল, ওয়ানডে ক্রিকেটে তেমনটা দেখা যায়নি। তারও কারণ আছে টেস্ট ক্রিকেটে যতটা খেলার সুযোগ পেতেন ওয়ানডে ক্রিকেটে তেমনটা পেতেন না। তাইতো টেস্ট অভিষেকের পায় তিন বছর পরে হয় তাঁর ওয়ানডে অভিষেক। তাঁকে টেস্ট বোলার হিসেবে বিবেচনা করা হত বেশি, যেমনটা এখন মমিনুলের বেলায় দেখা যাচ্ছে।
আসার যাওয়ার মধ্যে বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ১৫টি, তার বিপরীতে ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেয়েছেন মাত্র ১০টি। পনেরো টেস্টে উইকেট পেয়েছেন ৪৪টি, ইনিংসে পাঁচ উইকেট পেয়েছেন তিনবার। ১০ ওয়ানডেতে উইকেট সংখ্যা ১৪, ইকোনমি বেশ ভাল ৪.৩৯।
২০০৭ সালে বছর খানেক পরে টেস্ট ম্যাচে খেলে বাংলাদেশ। দীর্ঘ এই বিরতির কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। টেস্ট ক্রিকেটে আর আগের মত সাফল্যের দেখা পাননি। ভারতের বিপক্ষে এক টেস্ট খেলে বাদ পড়েন দল থেকে।
এনামুল হক জুনিয়র খেলেছেন ইংল্যান্ডের মাইনর কাউন্টি ক্রিকেট লিগে, খেলেছেন ভারতের রঞ্জিত ট্রপিতেও। ২০০৮ সালে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে মহারাষ্ট্রের হয়ে নাম লেখান রঞ্জিত ট্রপিতে। তার আগে মাইনর কাউন্টি ক্রিকেটে খেলে বেশ সাফল্য পান তিনি। মাইনর কাউন্টি ক্রিকেটে ভাল পারফর্মেন্সের পাশাপাশি দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটেও ভাল খেলেন তিনি। যার ফলে জাতীয় দলে ডাক পান আবার, ২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ জাতীয় দলে ছিলেন, সেসময় নিউজিল্যান্ড বিপক্ষে একটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে একটি টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। বল হাতে উইকেটও পান। এক টেস্ট খেলে আবারও বাদ পড়ে যান।
ক্রিকেটের দুই ফরম্যাটে তাঁকে বিবেচনা করা হলে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ পেতেন আরো বেশি। শ দুয়েক উইকেটও থাকত তাঁর নামের পাশে। তাঁর সেই সামর্থ্য ছিল। প্রয়োজনটা ছিল পর্যাপ্ত সুযোগের, সেটা তিনি পাননি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার লম্বা না হলেও দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে যাচ্ছেন এখনো। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে দ্বিতীয় সেরা উইকেট সংগ্রাহক তিনি। উইকেট সংখ্যা ৪৮৪, পাঁচশ উইকেটের মাইল ফলক স্পর্শ করতে দরকার মাত্র ১৬টি উইকেটের। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের মতই সফল লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটেও। ১২৬ ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ১৬৩টি, ইকোনমি রেট ৪.৩১। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে এমন ইকোনমি মানানসই।
ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ টি-টোয়েন্টিতেও বেশ কার্যকরী স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) প্রথম আসরর সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক ছিলেন এই স্পিনার। বিপিএলের প্রথম দুই আসরে ২৪ ম্যাচে উইকেট নিয়েছিলেন ৩১টি। এখনো পর্যন্ত টি-টোয়েন্টিতে ৪৪ ম্যাচে ৫১ উইকেট তাঁর ঝুলিতে, ইকোনমি ৬.৬৭। ক্রিকেটের এই ছোট সংস্করণে এমন পারফর্মেন্স নজর কাড়ার মত। বিপিএলের প্রথম দুই আসরে ভাল করার পরও পরের আসর গুলোতে তাঁকে দল নিতে আগ্রহ দেখায়নি কোনো দল। দীর্ঘ বিরতির পর বঙ্গবন্ধু বিপিএলে সুযোগ পান চট্টগ্রাম দলে, মাত্র এক ম্যাচ খেলার সুযোগ পান। সেই ম্যাচে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। দুই ওভারে ১৬ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শুন্য।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রায় শেষ প্রান্তে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক এনামুল হক জুনিয়র। বয়সটা বাড়ছে দিন দিন,তবে, বয়স যতই হোক লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলে যাচ্ছেন এই স্পিনার তরুনদের সাথে পাল্লা দিয়ে বল হাতে পারফর্মও করছেন সমানতালে। তার এই লড়াইটার জন্য স্যালুট।