সালটা ২০০০। এক ঝাঁক উনিশের হাত ধরে সেবার ভারত অনূর্ধ্ব ১৯ দল বিশ্বজয় করলো। ঐ বিশ্বজয়ের পর পরই ভারতীয় ক্রিকেটের প্রবেশদ্বারে আগমন ঘটলো এক তরুণের। শচীন, সৌরভ, শেবাগের পর আরেক রুদ্রমূর্তি হিসেবে আবিভার্ব ঘটলো যুবরাজ সিংয়ের ।
পাঞ্জাবের চনমনে তরুণ। ক্রিকেটের সাথে জীবনটাও উপভোগ করেন। মাঠের বাইরে সব সময় মাতিয়ে রাখা যুবরাজ বাইশ গজে গিয়েই বা ক্ষান্তি দেবেন কেন? সেখানেও তাঁর সরব বিচরণ। উপচে পড়া গ্যালারি যেন যুবরাজের ঐন্দ্রজালিকায় আরো উন্মত্ত হয়ে উঠত।
নিজের ব্যাটের স্পর্শে তাবড় তাবড় বোলারদের করতেন বিধ্বস্ত। বারে বারে সীমানা প্রান্তে আছড়ে পড়তো বল। কখনো বাউন্ডারি লাইন ছুঁয়ে আবার কখনো নীল আকাশে পাড়ি দিত তাঁর হিট করা বল।
নাম যুবরাজ। ভারতের ক্রিকেটেও তিনি যুবরাজ। ২০০০ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১১ বছর বাদে ২০১১ সালে ভারতের ২৮ বছরের আক্ষেপ কাটানোর নায়কও তিনিই ছিলেন। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে তাই তাঁর ‘যুবরাজ’ নামটা স্বার্থকই বলা চলে।
মহানায়কদের প্রস্থান হয়, ভারতের যুবরাজেরও প্রস্থান হয়েছিল। ২০১১ বিশ্বকাপের পর দেহে দানা বেঁধেছিল মরণ ব্যধি ক্যান্সার। ক্যান্সারকে জয় করে ফিরেছিলেন বটে।
কিন্তু, ভারতের ক্রিকেট থেকে ততদিনে তিনি কক্ষচ্যুত হয়ে গেছেন। ২০১১ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় খেলতে পারলেন না পরের বিশ্বকাপে। বাইশ গজের সেখানেই নিজের শেষ দেখে ফেলেন যুবরাজ সিং।
তবে স্টুয়ার্ট ব্রডের ৬ বলে ৬ ছক্কার বর্ষণ, ব্রেট লি, নাথান ব্র্যাকেনদের বলে ঐশ্বরিক ফ্লিক, ১১ এর যুবরাজকীয় বিশ্বকাপ কি আর ভারতের যুবরাজকে আড়ালে যেতে দেয়? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যুবরাজের অসংখ্য কীর্তির স্মৃতিতে সেই পুরনো মুহূর্ত আবার ফিরে আসে।
এই যেমন রোড সেফটি ওয়ার্ল্ড সিরিজ খেলা চলাকালীন ইন্ডিয়া লিজেন্ডসের ক্রিকেটার রিতিন্দার সোধি তাঁর স্মৃতিচারণা ফিরে গিয়েছিলেন ২২ বছর আগে। যেবার যুবরাজ সিংয়ের তিনিও অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। এবারও একই সাথে ইন্ডিয়া লিজেন্ডসের হয়ে খেলছেন রিতিন্দর আর যুবরাজ সিং।
খেলার বিরতিতে রিতিন্দার সোধি সেই যুবরাজের সাথে তাঁর স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘যুবরাজ সিং সবসময়ই চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার ছিল। ম্যাচের পরিস্থিতি যেখানেই থাকুক না কেন ও সব সময় জিততে চাইতো। এটাই ওকে অন্য ক্রিকেটারদের চেয়ে আলাদা করে। ২০০০ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের একটা স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে। সে আসরে শেন ওয়াটসন, মিচেল জনসনদের নিয়ে অস্ট্রেলিয়া খুব শক্ত দল। সেমিতে আমাদের প্রতিপক্ষ ওরাই ছিল। ড্রেসিং রুমে আমরা সবাই এ ম্যাচ নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু যুবির যেন এ ম্যাচ নিয়ে চিন্তায় নেই। যেন ও ধরেই নিয়েছে, এই ম্যাচ এমনিতেই জিতে যাবে।’
রিতিন্দার আরো বলেন, ‘ম্যাচের শুরুতে আমরা ব্যাটিং করলাম। রভনীত রিকি সেঞ্চুরিও করলো। কিন্তু রিকি আর মানিশ শর্মা খুবই ধীর গতিতে ব্যাট করেছিল। ঐ সময় আমাদের রানের গতি বাড়ানোর খুব দরকার ছিল। যুবি যখন ব্যাটে নামছে তখন আমাদের রান ৪২.৫ ওভারে ২০২। ও ব্যাটিংয়ে নামার সময় আমি বললাম, যুবি, স্কোরবোর্ডে রান কম। রান বাড়াতে হবে। তখন ও আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলল, আরে… চিন্তা করো না। আমি মাঠে যাচ্ছি। আমি আমার খেলাটা খেলে আসছি। শুধু দেখো’। ওর এমন আত্মবিশ্বাসে সত্যি অবাক হতাম। তাও আবার ম্যাচের কঠিন পরিস্থিতিতেই ও এমন নির্ভার থাকতো। ’
রিতিন্দারকে দেওয়া কথাটা সে ম্যাচে রেখেছিলেন যুবরাজ সিং। ২৫ বলে ঝড়ো ৫৮ রানের ইনিংস খেলে ভারতের দলীয় সংগ্রহ এক ঝটকায় নিয়ে গিয়েছিলেন ২৮৩ তে। আর সেমির সে ম্যাচ জিতে ভারতও তাদের পথের কাঁটা অস্ট্রেলিয়া সরিয়ে দিয়েছিল।
যে কোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে পাল্টা আক্রমণের মানসিকতা যুবরাজ সিংয়ের সহজাত ধরন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এর দেখা মিলেছে বহুবার। ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার দেয়া ২৭৫ রানের টার্গেটে শচীন, শেবাগ ফিরে যাওয়ায় ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপ তখন মালিঙ্গার পেসে রীতিমত স্ট্রাগল করেছে।
সেই সময় ক্যামেরা খুঁজে নিল যুবরাজকে। সেখানে দেখা গেল, হেডফোনে গান শুনছেন তিনি। জাগতিক যে কোনো বিপদেও যেন তাঁর কোনো ভাবনা নেই।
যুবরাজকে এই জয়ী মনোভাবই অনন্য করেছিল। তাই ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ক্যান্সারে জর্জর হলেও বলের মতো ক্যান্সারকেও বাউন্ডারি ছাড়া করে দূর আকাশে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর ফিরেছিলেন ক্রিকেটে। তবে ফেরাটা আর ‘যুবরাজ’ এর মতো হয়নি। কিন্তু তাতে কী! ভারতের ক্রিকেটে তো তিনি বেশ আগেই যুবরাজ হয়ে গিয়েছেন। যুবরাজ হয়ে এখন আছেনও। ভারতের শেষ বিশ্বকাপজয়ের মহানায়ক তো আর কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার নয়।