সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। কলকাতার আকাশও ভোল বদলালো। এক মুহূর্তের মধ্যে বৃষ্টি স্নানে পাল্টে গেল গোটা শহরের চিত্রটা। কলকাতায় যখন ঝুম বৃষ্টি, রাজকোটে তখন ঝলমলে রোদ। সেই রৌদ্দুর প্রান্তরে চলছে ইরানি ট্রফির ম্যাচ। সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে রেস্ট অফ ইন্ডিয়ার হয়ে সে ম্যাচটি খেলছেন এক বাঙালি যুবক। বিহার হয়ে কলকাতা থেকে উঠে আসা ২৯ বছর বয়সী সেই যুবকের নাম মুকেশ কুমার।
সবে মাত্র ইরানি ট্রফির দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে হোটেলে ঢুকেছেন মুকেশ। হঠাৎ খবর এল দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ওয়ান ডে সিরিজের দলে ডাক পেয়েছেন তিনি। তাও খবরটা পেলেন অদ্ভুত ভাবে। হোটেলে ঢুকে হোয়াটস অ্যাপ চেক করতে গিয়ে দেখলেন ভারতের অফিশিয়াল হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে তাঁকে যুক্ত করা হয়েছে। হোয়াটস অ্যাপ থেকে পাওয়া খবর কি নির্ভরযোগ্য?
এই ভেবে নিজেও নিশ্চিত হওয়ার জন্য এদিক ওদিক ফোন দিতে শুরু করলেন। পরে দেখলেন, সত্যিই তিনি ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন। এমন খবরে মুকেশের তাৎক্ষণিক উচ্ছ্বাসটা টের পায় তাঁর ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা মানুষ গুলোও। সাক্ষী হয় মুকেশের এমন কিছু উচ্ছ্বসিত কথায়, ‘কলকাতায় পুজো চলছে, আর সেই সময় কি না আমি ইন্ডিয়া কল পেয়ে গেলাম! আমি আর শাহবাজ একই সঙ্গে। মাতারাণীর কৃপা, বুঝলেন পুরোটাই উপরওয়ালার কৃপা।’
তবে ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়াতে মুকেশ কুমার যে শুধু উচ্ছ্বাসেই ভেসে গেছেন তেমনটিও নয়। আবেক্রান্তও হয়ে পড়েছিলেন বাবার কথা স্মরণ করে। গতবছর ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান মুকেশের বাবা কাশীনাথ সিং। ছেলে বড় ক্রিকেটার হতে পারে, ভারতীয় দলে সুযোগ পেতে পারে, কখনও এমনটা মনে করতেন না মুকেশ কুমারের প্রয়াত বাবা কাশীনাথ সিং। এমনকি, বেঙ্গলের হয়ে রঞ্জি দলে সুযোগ পাওয়ার পরও নয়।
বারবার ছেলেকে সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করার কথা বলতেন। সেই ছেলেই আজ জাতীয় দলে। ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর বাবার কথা স্মরণ করে মুকেশ বলেন, ‘খবরটা জানার পর আমি খুবই আবেগ প্রবন হয়ে পড়েছিলাম। চোখের সামনে প্রয়াত বাবার মুখটাই বারবার ভেসে উঠছিল। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলার আগে পর্যন্ত বাবা বিশ্বাস করতেন না যে, পেশাদার ক্রিকেট খেলার জন্য আমি উপযুক্ত। ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে আমার স্বপ্নপূরণ হল। বাবা যদি বেঁচে থাকতেন তবে তিনি সবচেয়ে খুশি হতেন।’
বিহারের গোপালগঞ্জের কাকরকুণ্ডে জন্ম মুকেশ কুমারের। ক্রিকেটের প্রতি নেশা থাকলেও ছোট বেলায় স্বপ্ন দেখতেন সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার। কাকরকুণ্ড থেকে গোপালগঞ্জের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। অবাক করা ব্যাপার হল, আসা-যাওয়া মিলিয়ে সে এই ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিত সাইকেলে করে। সাইকেলে আসার তাঁর একটিই কারণ ছিল, পায়ের মাসল যেন ঠিক থাকে। যাতে করে সেনাবাহিনীতে সহজে সুযোগ পাওয়া যায়। তবে মুকেশ কুমারের সে চেষ্টাটা সফল হয়নি। তিনবার পরীক্ষা দিলেও একবারের জন্যও তিনি উর্ত্তীর্ণ হতে পারেন নি সেনাবাহিনীর বাছাইয়ে।
মুকেশের বাবা কলকাতায় ট্যাক্সির ব্যবসা করতেন। ২০১২ সালে বেশ খানিকটা ক্ষতি হল তাঁর। এ কারণে বিহার ছেড়ে কলকাতায় চলে আসে মুকেশ। স্থানীয় ক্রিকেট লিগে ম্যাচ প্রতি ৪০০/৫০০ রুপির বিনিময়ে খেলা শুরু করলেন তিনি। এতে আয় রোজগার ভালই হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু বাবা ক্রিকেটের ঘোরতর বিরোধী। আর মুকেশের চোখে ক্রিকেট নিয়ে তখন আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন।
মুকেশ তাঁর স্বপ্নের পথে এক পা এগিয়ে যান ২০১৪ সালে। ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল সেবার আয়োজন করেছিল ভিশন-২০২০ প্রোগ্রাম। সে ট্রায়ালে পরীক্ষক হিসেবে ছিলেন বেঙ্গলের সাবেক পেসার রণদেব বোস। এ ছাড়া আরও ছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ, ওয়াকার ইউনুস, মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো ক্রিকেট কিংবদন্তিরা।
ওয়াকার ইউনুস সেবার মুকেশ কুমারের বোলিং দেখে বেশ মুগ্ধ হন। সুযোগ পান ক্লাব ক্রিকেটে। এর পরে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সব কিছুই যেন খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে থাকলো। ক্লাব ক্রিকেটে দুরন্ত বোলিং করে ২০১৫ সালে বাংলার সিনিয়র দলে সুযোগ পান মুকেশ। বাংলার হয়ে ধারাবাহিকভাবে দুরন্ত বোলিং করায় সুযোগ পান ‘এ’ দলে। নিউজিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে তুলে নেন পাঁচ উইকেট। এরপর ইরানি কাপেও চমক দেখান তিনি। প্রথম ইনিংসে নেন চার উইকেট।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার জুড়ে মুকেশের সবকিছু আচমকা ঘটলেও এ যাত্রায় তাঁর প্রতিবন্ধকতাও ছিল অনেক। স্পোর্টস শ্যু কেনার মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না তাঁর। এক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল (সিএবি) কর্তা শেষ পর্যন্ত মুকেশকে নিজের ক্লাবে সই করিয়ে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন মুকেশকে। যা দিয়ে তিনটি জুতা কেনা হয়েছিল। বাঁধা-বিপত্তির পরেও তাড়া করেছিল মুকেশকে।
দীর্ঘদিনের অপুষ্টির কারণে হাড়ের রোগ হয় মুকেশের। এবারও ত্রাতা হিসেবে হাজির হন রণদেব। তৎকালীন সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলিকে গিয়ে সব কিছু বলেন তিনি। সৌরভই মুকেশের চিকিৎসার সমস্ত বন্দোবস্ত করে দেন। এছাড়া বেঙ্গলের আরেক তারকা মনোজ তিওয়ারিও নিজের ‘কিট’ মুকেশ কুমারকে দিয়ে দিতেন যাতে করে আলাদা করে তাঁর ঐ কিট কেনা না লাগে।
ভারতের হয়ে সুযোগ পাওয়ার পর এসব কৃতজ্ঞতার কথা অবশ্য ভুলে যাননি মুকেশ। শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন রণদেব বোস আর ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলকে। এ ছাড়া এক সময়ের সতীর্থ মনোজ তিওয়ারির সহযোগিতার কথাও ভুলে যাননি তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই ভাগ্যবান যে তাদের কাছে পেয়েছিলাম। কারণ আমার বাবা আমাকে এক বছর সময় দিয়েছিলেন। সে সময়ে রণদেব স্যার, অরূন লাল স্যার, মনোজ দা এভাবে সহযোগিতা না করলে কখনোই আমি এ পর্যায়ে আসতে পারতাম না।’
বেঙ্গলের সাবেক কোচ অরূণ লালা মুকেশ কুমারকে আবিষ্কার করেছেন একটু অন্যভাবে। তাঁর মতে, ‘মুকেশ এমন একজন বোলার যে অফ স্ট্যাম্প লাইন বরাবর ওভারের পর ওভার লং স্পেলে বল করে যেতে পারে। ও অনেকটা পাকিস্তানের মোহাম্মদ আব্বাসের মতো। ১৪০ কিলোমিটার গতিতে হয়তো টানা বল করবে না। কিন্তু ব্যাটারকে কখনো শট খেলার জায়গা দিবে না। মুকেশের বোলিংয়ের সময় এ জন্য স্লিপে ফিল্ডার বেশি রাখা প্রয়োজন।’
মুকেশ কুমারের ক্যারিয়ার কেবল শুরু মাত্র। তাঁর এ স্বপ্নীল যাত্রা কতটা সুন্দর হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে বিহারের এ তরুণের লড়াই, প্রতিবন্ধকতা ভেঙ্গে উঠে আসাই তো অনেকের কাছে স্বাপ্নিক ব্যাপার। যদিও এখানেই হয়তো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন না মুকেশ নিজেও। লোকাল ক্রিকেট খেলার সময়ই যে ছেলে ভারতের নীল জার্সি গায়ে চাপানোর স্বপ্নে বিভোর থাকতো, সেটি পূরণ হওয়ার পর সে তো এখন আরও অনেক দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করবে। কারণ মুকেশরা হারিয়ে যেতে চান না।