ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে ভারতের নতুন ভরসা

হরিয়ানার হাতিনে গিয়ে কেউ তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলে সবার চোখে-মুখে ফুটে উঠে এক মুগ্ধতা। আইপিএলে ব্যাঙ্গালুরুতে সুযোগ পাওয়া ছেলেটার চাইতে তাঁর দৃষ্টিনন্দন বাড়ি নিয়েই বেশি আগ্রহ বোধহয় স্থানীয় জনগণের। রাস্তায় ক্রিকেট খেলা শিশুরাও তাকিয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। তাঁদের সেই দৃষ্টিতে লুকিয়ে বড় ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন, আলিশান বাড়ির অধিপতি হবার বাসনা।

এই পথে খেলেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছে পাড়ার বড় ভাই, সুতরাং তাঁদের স্বপ্ন দেখতে বাঁধা কোথায়! যেই ক্রিকেটারের কথা বলা হচ্ছিল তিনি ভারতের ক্রিকেট আকাশের নতুন নক্ষত্র, শাহবাজ আহমেদ। মেওয়াটের পরে হরিয়ানার সবচেয়ে অনুন্নত এলাকা হচ্ছে পালওয়াল। সেই অঞ্চলেরই ছেলে শাহবাজ। নিজের প্রতিভা আর নিষ্ঠার জোরে আইপিএল মাতিয়ে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া এই তরুণ এখন পালওয়ালের প্রতিটি ক্রিকেটপ্রেমী তরুণের আদর্শ।

ছেলে বড় ক্রিকেটার হলেও শাহবাজের বাবা আহমেদ জান নিজে ডাক বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা। আলিশান বাড়ি দেখে সবাই ছেলের আইপিএল নিলামের টাকায় বানানো ভাবলেও ভুলটা ভাঙ্গে তাঁর বাবার সাথে কথা বলার পর। ‘আমি তাঁর উপার্জনের একটা পয়সাও নিই না। আমি যথেষ্ট উপার্জন করি এবং তা আমার পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্য যথেষ্ট।’, বলেন আহমেদ জান। আইপিএলে আলো ছড়ানোর পর সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জাতীয় দলের হয়ে অভিষেক ঘটে তাঁর। রবীন্দ্র জাদেজা কিংবা রবীচন্দ্রন অশ্বিন পরবর্তী যুগে তাঁকেই ভাবা হচ্ছে ভারতের ভবিষ্যত অলরাউন্ডার।

ক্রিকেট মাঠে এত এত সাফল্যের পরও আজও আহমেদ জান ভেবে পান না কি করে তাঁর শান্ত, সুবোধ ছেলেটা ক্রিকেটে জড়িয়ে পড়লো। স্কুল-কলেজে দারুণ রেজাল্ট  করে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হওয়া ছেলেটা ব্যাট-বলের নেশায় কিনা অসম্পূর্ণ রেখেছিল পড়ালেখাটা। তাতে করে আক্ষেপের শেষ নেই তাঁর বাবার।

তিনি বলেন, ‘অন্য দশটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো আমরাও ক্রিকেট দেখতে ভীষণ পছন্দ করি। কিন্তু, পড়ালেখা সবার উপরে। আমার বাবা ছিলেন হেডমাস্টার, আমি সরকারি চাকুরে, আমার ছোট ভাই শিক্ষক, বোন ডাক্তার। এমনকি শাহবাজও পড়ালেখায় দারুণ ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে ৮৮% নম্বর পেয়েছিল সে। আমি দু:স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি আমার ছেলে ক্রিকেটের জন্য লেখাপড়া ছেড়ে দেবে। কোনো বাবাই চাইবেন না তাঁর ছেলে লেখাপড়া ছেড়ে দিক।’

তবে ছেলের ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে সবসময় সমর্থন দিয়েছেন শাহবাজের মা অবনম। বাবার বকুনি কিংবা চোখ রাঙানিতে ভয় পাওয়া ছেলেকে আচলের তলায় আশ্রয় দিয়েছেন তিনি। ‘উনি এখনো ২০১৫ সালেই পড়ে আছেন। আমি অবশ্যই চেয়েছি ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী পাক, ভালো চাকরি করুক। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু সময় আসে যখন ওদের সিদ্ধান্ত ওদেরই নিতে দিতে হয়, শুনতে হয় ওদের কথা। বুঝতে হয় জীবনকে ওরা কিভাবে সাজাতে চায়’, একগাল হাসিমাখামুখে এসবই বলেন অবনম। 

তবে করোনা মহামারীতে যখন ক্রিকেট বন্ধ ছিল, সেই সময়টাতে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রীটা শেষ করে বাবার মুখে হাসি ফুটিয়েছে শাহবাজ। বর্তমানে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াতে চাকুরি কিংবা পড়ালেখা নিয়ে আর আক্ষেপ নেই আহমেদ জানের। এখন তাঁর কেবল একটাই চিন্তা বাড়িতে কি করে ছেলের ট্রফি সাজানোর রুমটা বড় করা যায়।  

একটু পেছনে ফিরে যাই, শাহবাজের শুরুর দিনগুলোতে। আহমেদ জান-অবনম দম্পতি সেই দিনটির কথা কখনো ভুলবেন না যেদিন শাহবাজের কলেজ থেকে চিঠি আসে যে তাঁদের ছেলে ক্লাসে যাচ্ছে না কয়েক মাস যাবৎ। খবর পেয়েই চিন্তিত পিতামাতা দ্রুতই ছুঁটে আসেন গুরুগাওতে ছেলের কাছে। কিন্তু এসে দেখেন ছেলে এর মাঝেই বেরিয়ে পড়েছে ক্রিকেট খেলতে। কলেজচ কর্তৃপক্ষও শোনাতে পারেনি কোনো আশার বাণী।

‘সেবারই আমরা প্রথম জানতে পারি সে ক্রিকেটকে এতোটা ভালোবাসে। এমনকি সে দুই বছর ধরে হরিয়ানার বয়সভিত্তিক দলে খেলছে সেটাও জানতে পারি প্রথমবারের মতো’, স্মরণ করেন আহমেদ। 

এরপরই ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বাবা-মাকে জানান শাহবাজ। ক্রিকেটে আরো সুযোগের আশায় ছাড়তে চান হরিয়ানা, পড়ালেখা ছেড়ে পাড়ি জমাতে চান সুদূর কলকাতায়। শুরুতে অমত থাকলেও ছেলের জেদের কাছে হার মানেন বাবা-মা। শিক্ষকরা পর্যন্ত হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন দারুণ মেধাবীর শিক্ষার্থীর এহেন সিদ্ধান্তে।

কলকাতায় শুরুর দিনগুলো খুব কষ্টে কেটেছে শাহবাজের। ছোট্ট এক রুমে গাদাগাদি করে থাকতে হতো তাঁকে। দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে গেছেন সেই দিনগুলো, জানতেন লেগে থাকলে একদিন সফলতা আসবেই। মাঝে একবার নেমে এসেছিল নিষেধাজ্ঞার খড়গ,পরবর্তীতে নতুন করে তদন্তের পর পুনরায় সুযোগ পান বাংলার হয়ে খেলার।

তবে কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে, মূলমন্ত্র হিসেবে সবসময় স্মরণে রেখেছেন কলকাতার প্লেনে উঠার আগে বাবার সেই কথা, ‘জীবনে অনেক কিছু অর্জন করতে হবে তোমাকে, তবে হাতে কিন্তু খুব বেশি সময় নেই।’

কলকাতায় দ্বিতীয় বিভাগ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও দ্রতই নজরে আসেন পার্থ প্রতিম চৌধুরির। শাহবাজের ব্যাটে-বলের দারুণ দক্ষতা নজর এড়ায় না তাঁর। তিনি শাহবাজকে সুযোগ করে দেন তপন মেমোরিয়াল ক্লাবে। ‘সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ছেলের মাথার উপর ছাদ হয়ে দাড়িয়েছিলেন  পার্থ স্যার। নিজের ছেলের মতো আগলে রেখেছেন শাহবাজকে। আমি সারাজীবন উনার জন্য প্রার্থনা করবো।’, পার্থ চৌধুরির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন অবনম।

এরপর আর পেছনে তাকানোর প্রয়োজনই পড়েনি। শাহবাজ সামনে এগিয়েছেন দুরন্ত গতিতে। মনোজ তিওয়ারির নজরে আসেন কলকাতা লিগে দারুণ পারফর্ম করে, পরে তাঁর জোরাজুরিতেই অবাঙ্গালি হওয়া সত্ত্বেও ডাক পান বাংলারে রঞ্জি দলে। বাংলার ড্রেসিঙ্গরুমে অরুন লালের সান্নিধ্যে এসে কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফোঁটা শাহবাজের। লাল তাঁকে ডাকতেন দুঃসময়ের কান্ডারি বলে।

দলের দু:সময়ে সবসময়েই জ্বলে উঠেছেন শাহবাজ। কখনো দলকে বিপদমুক্ত করেছেন ব্যাট হাতে, আবার কখনো ভেলকি দেখিয়েছেন বাঁহাতি স্পিনে। ২০১৯-২০ মৌসুমে বাংলাকে রঞ্জির ফাইনালে তোলার পথে ৫০৯ রানের পাশাপাশি ৩৫ উইকেট নিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এই অলরাউন্ডার। এরপরই আইপিএলে ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে ডাক পাওয়া। গত তিন বছরে নিজেকে পরিণত করেছেন দলটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে। আর এখন তো খেলবেন জাতীয় দলে একশ ত্রিশ কোটির প্রতিনিধি হয়ে। সময়টা তো এখন শাহবাজেরই, ডানা মেলে তিনি উড়বেন মুক্ত আকাশে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link