ব্যাটিংয়ের ‘শান’ মাসুদ

‘পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি’ উক্তির যৌক্তিকতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তিনি। টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে আবির্ভাব হলেও পরিশ্রম আর কঠোর সাধনায় নিজেকে উপযোগী করে তুলেছেন সাদা বলের ক্রিকেটেও। এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ভঙ্গুর মিডল অর্ডারের মূল ভরসা তিনি। দলের প্রয়োজনে একপ্রান্ত ধরে খেলা কিংবা সহজাত স্ট্রোকপ্লেতে দ্রুত রান তোলা- দুই ভূমিকাতেই তিনি সমান সাবলীল। তিনি শান মাসুদ, আসন্ন টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাক অধিনায়ক বাবর আজমের তুরুপের তাস। 

ব্যাংকার বাবার সুবাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কুয়েতে জন্ম এবং বেড়ে উঠা শানের। পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে দূরে থাকলেও সময়টা ভালোই কাটছিল। কিন্তু বাধ সাধলো পারস্যের উপসাগরীয় যুদ্ধ। যুদ্ধে ইরাক কুয়েত দখল করে নিলে পাকিস্তানে ফিরে আসে তাঁর পরিবার। পাকিস্তান ফিরলেও শান লন্ডনে দিন পার করেন লেখাপড়ার খাতিরে। ক্রিকেটকেই জীবনের ধ্যানজ্ঞান মনে করলেও পড়ালেখাতেও দারুণ মেধাবী এই ক্রিকেটার। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন অর্থনীতিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট দলের হয়ে দারুণ কিছু পারফরম্যান্স রয়েছে তাঁর।

বাঁহাতি ব্যাটসম্যান শানকে শুরুতে ভাবা হয়েছিল টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে। অবশ্য তাঁর কারনও ছিল, ঘরোয়া লাল বলের ক্রিকেটে তিনি রান করছিলেন দেদারসে। ধৈর্য্য, উইকেটে টিকে থাকার ক্ষমতা, বল ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা- সবমিলিয়ে তিনি ছিলেন যোগ্য এক টেস্ট ব্যাটার। করাচির হয়ে অভিষেকেই ৫৪ রানের ইনিংস খেলার পাশাপাশি আসাদ শফিককে নিয়ে গড়েন ১৫৪ রানের জুটি। রানের ধারাটা বজায় রাখেন মৌসুম জুড়েই। ফলে দ্রুতই খুলে যায় জাতীয় দলের দরজা। 

২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটে শানের। অভিষেক ম্যাচেই নিজের সামর্থ্যের জানান দেন তিনি, ফিল্যান্ডার-স্টেইনদের সামলে খেলেন ৭৫ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। দুই বছর বাদেই শ্রীলংকার বিপক্ষে দেখা পান তিন অংকের ম্যাজিক ফিগারের। ইউনুস খানের সাথে তাঁর গড়া ২৪২ রানের অনবদ্য এক জুটির সুবাদেই লংকানদের দেয়া ৩৮২ রান তাঁড়া করে মহাকাব্যিক এক জয় পায় পাকিস্তান। কিন্তু এরপরই হঠাৎ করে রানে ভাটা পড়ে মাসুদের।

২০১৬ ইংল্যান্ড সফরে রীতিমতো হ-য-ব-র-ল এক সিরিজ কাটান। চার ইনিংসে তাঁর মোট রানই ছাড়াতে পারেনি পঞ্চাশের কোটা।  একদিকে আজহার আলী, বাবর আজম, ইমাম উল হকদের উত্থান, অন্যদিকে তাঁর রানখরা- সবমিলিয়ে একসময় জাতীয় দলের দৌড় থেকে ছিটকে যান তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটেও ঠিক পুরনো রূপে ফিরতে পারছিলেন না। এমতাবস্থায় প্রখ্যাত কোচ মিকি আর্থারের পরামর্শে ইংল্যান্ডে কাউন্টি খেলতে চলে যান তিনি।

শান মাসুদের সবচেয়ে বড় গুণ তিনি হাল ছাড়েন না, লেগে থাকতে জানেন। ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়ে বুঝতে পারেন তাঁর হাতে শট খুব কম, ফলে বোলার ভালো লেংথে বল করলে তিনি কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়েন। সেখানে খেলার সময় তাই নিজের ব্যাটিং নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন, নেটে সময় কাটাতে লাগেন দিনের পর দিন। নতুন নতুন শট আয়ত্বে আনলেন, অভ্যাস করলেন উইকেটের চারপাশে খেলার। টেস্টের ব্যাটসম্যান তকমা থেকে বেরিয়ে নিজেকে পরিণত করলেন শর্টার ভার্সন ক্রিকেটেও সমান কার্যকরী ক্রিকেটাররূপে।

ডার্বিশায়ারের হয়ে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টানা দুই ম্যাচে হাকান ডাবল সেঞ্চুরি। কাউন্টিতে ভালো খেলার সুবাদে পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) দল মুলতান সুলতান্স দলে ভেড়ায় তাঁকে। পিএসএলেই তাঁকে প্রথমবারের ভিন্ন এক রূপে আবিষ্কার করে পাকিস্তানের ক্রিকেট সমর্থকরা। তাঁদের হয়ে চার আসরে পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংস খেলেন সাতবার। পাশাপাশি ১৩৬ স্ট্রাইকরেট জানান দেয় ব্যাট হাতে কতোটা বিধ্বংসী হবার সামর্থ্য রাখেন শান। 

সবাই বুঝতে পেরেছিল জাতীয় দলে শানের প্রত্যাবর্তন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু এর মাঝে তাঁর জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ, পরলোকগমন করেন তাঁর বোন। মূহুর্তের মাঝে পুরো জীবনে যেন অন্ধকার নেমে আসে। বোনের মৃত্যুর পর জীবনদর্শন পালটে যায় শানের। ক্রিকেটটাকে দেখতে শুরু করেন নতুন দৃষ্টিতে। শোককে শক্তিতে পরিণত করে ব্যাটটাকে আঁকড়ে ধরেন আরো প্রবলভাবে। কষ্টটাকে যেন ভুলে থাকতে চেষ্টা করেন গোল বলটাকে সীমানার ওপারে পাঠিয়ে। 

টি টোয়েন্টিতে বিশ্বকাপের আগে তাই মিডল অর্ডার নিয়ে সংকটাপন্ন পাকিস্তান শরণাপন্ন হয় শানের। তিনিও হতাশ করেননি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ এক ফিফটি হাঁকিয়ে জানান দিয়েছেন নিজের সামর্থ্যের। এখনো পর্যন্ত পাকিস্তানের হয়ে নয় টি-টোয়েন্টিতে মাঠে নেমে  দুই ফিফটিতে তাঁর সংগ্রহ ১৮৭ রান।

২০০৯ বিশ্বকাপের পর আবারো স্বপ্ন দেখছে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পাকিস্তানে ফেরানোর, আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তানের জন্য সেটা অসম্ভবও নয় বটে। বাবর-রিজওয়ানের উদ্বোধনী জুটি কিংবা দুর্দান্ত পেস বোলিং লাইন আপ থাকলেও তাঁদের মূল দুশ্চিন্তাটা মাঝের ব্যাটারদের নিয়ে। শানের সামনে তাই সুযোগ বিশ্বকাপে দারুণ পারফর্ম করে পাকিস্তানি সমর্থকদের মনে স্থান করে নেয়ার। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link