ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান তিনি। পুরো একটা প্রজন্মকে তিনি মাতিয়ে রেখেছেন উইলো কাঠের মায়াবি ছোঁয়ায়। ব্যাটটাকে তুলি বানিয়ে যেন অনবদ্য সব শিল্পকর্ম এঁকে যান বাইশ গজে। অথচ তাঁর বেড়ে ওঠা ছিল আট দশটা সাধারণ মধ্যবিত্ত কিশোরের মতোই। জীবনে বহু ঝড় ঝাপটা এসেছে, সেসব সামলেই তিনি হয়েছে আজকের মহীরুহ। বলছিলাম বিরাট কোহলির কথা, যার দিল্লির সেই ছোট গলির ক্রিকেটার থেকে আজকের বিশ্বসেরা হবার যাত্রাটা ছিল কন্টকাকীর্ণ।
১২ বছর বয়সে বিরাট কোহলি একবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্কুটারে চেপে বাবার সঙ্গে ঘুড়ি কিনতে যাচ্ছিলেন। যাত্রার মাঝপথে কোহলির বাবা খেয়াল করেন ছেলেকে হেলমেট দিতে ভুলে গেছেন। ততক্ষণে আর ফিরে যাবার সময় নেই, সিনিয়র কোহলি তাই ভাগ্যে যা আছে হবে ভেবে যাত্রায় মনোনিবেশ করেন।
ঘুড়ি কেনা ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়, বিপত্তিটা ঘটে ফেরার সময়। ফেরার পথে কোহলির প্রিয় তরমুজ কিনতে এক ফলের দোকানে থামেন তাঁরা। সেখানে হঠাৎই পুলিশ দেখে তাড়াহুড়ো করে স্কুটারে চেপে বসেন তিনি। কিছুদূর যাবার পর বুঝতে পারেন ভুল হয়ে গেছে, তাড়াহুড়োয় ছেলেকে ফেলে চলে এসেছেন। পরে ফেরত এলেও কোহলি ততক্ষণে একাই বাড়ি চলে গেছেন। সেই ঘটনার পর দু’দিন তাঁর বাবার সাথে কথা বলেননি কোহলি।
এক শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনে তিনি যখন প্রথমবারের মতো আনুশকা শর্মার সাথে অভিনয়ের ডাক পান, তখন তিনি ভীষণ নার্ভাস ছিলেন অভিজ্ঞ এই বলিউড অভিনেত্রীর সাথে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হবে ভেবেই। ‘তুমি কি আরো কয়েক জোড়া হিল আনোনি ?’, বলে পরিস্থিতি খানিকটা হালকা করার চেষ্টা করেন কোহলি। যাই হোক তাঁর সেই কৌতুকে কেউ হাসেনি সেবার। তবে তিনদিনের সেই শ্যুটিং এ কোহলি-আনুশকা বাঁধা পড়ে গিয়েছিলেন যেন, দু’জনে আলাপ করেছেন জীবনের নানাবিধ বিষয়গুলো নিয়ে।
বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন হলেও কোহলি তাঁর শিকড়কে ভুলে যাননি, ভোলেননি কোথা থেকে উঠে এসেছেন। তাঁর বড় ভাইয়ের ব্যবসার অর্থ জোগাতে তাঁরা নিজেদের বাড়ি ভাড়া দিয়ে, অন্য বাসায় ভাড়া থাকতেন। যদিও তাঁর ভাইয়ের ব্যবসা সফলতার মুখ দেখেনি। ততদিনে অবশ্য কোহলিও দিল্লির ক্রিকেট পাড়ায় পরিচিত হননি, চেষ্টা করছেন পায়ের নিচে শক্ত মাটি খুঁজে পাবার।
কোহলির জীবনে অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন তাঁর বাবা, যিনি কারও সাহায্য ছাড়াই একা একাই জীবন সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছিলেন। স্ট্রোক এবং করোনারি হার্ট অ্যাটাকে যখন বাবা মারা যান, কোহলি ভেতরে ভেতরে একদম ভেঙে পড়েছিলেন। তবে অসম্ভব মানসিক দৃঢ়তার অধিকারী কোহলি বাবার মৃত্যুর সংবাদ জেনেও ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছিলেন।
কোহলির ভাষায়, ‘আমি কাঁদতে পারছিলাম না, আমার শূন্য শূন্য লাগছিলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কেবল ভাবছিলাম আমার কেন কান্না আসছে না। এক পর্যায়ে বুঝলাম বেদনার বুদবুদ ধীরে ধীরে আমার ভেতরে দানা বাঁধছে। সবাই আমার দিকে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। যখন সবাই আমার দিকে এগিয়ে এল, আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।’
বাবার মৃত্যু কোহলির জীবনে বেশ বড় প্রভাব রেখেছিল। ‘বাবা ২০০৬ সালের দিকে অনলাইনে শেয়ার মার্কেট ব্যবসা করতেন। হঠাৎ করে একদিন তাঁর অ্যাকাউন্ট ক্র্যাশ করে, লেনদেন বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর পূর্বে তিনি যত লেনদেন করেছিলেন এবং টাকা জমা করেছিলেন সব চলে যায়। এটা মানসিকভাবে তাঁর উপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। যার ফলেই তিনি স্ট্রোক করেন।’, পুরনো দিনের কথা স্মৃতিচারণ করে বলেন কোহলি।
দিনের খেলা শেষ করে কোহলি যখন তাঁর বাবার মৃতদেহ দাহ করতে শ্মশানে যান, সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাঁর পরিবারের আত্নীয়স্বজন সহ শুভাকাঙ্ক্ষী সকলেই। কোহলি সেখানেই তাঁর ভাইকে বলেন তাঁর খেলাধুলা এবং স্বপ্নের মাঝে কেউ যেন বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়।
কোহলি বলেন, ‘আমার জীবনে এর চাইতে ইম্প্যাক্টফুল কিছু কখনো ঘটেনি। আমার মনে পড়ে খেলা শেষে শ্মশানে আসি সৎকার এবং ধর্মীয় কার্যাদি সম্পন্ন করতে, আমি ভাইকে বলি আমি ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছি এবং আমার এই স্বপ্নপূরণ করা থেকে কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। এটা আমার বাবারও স্বপ্ন ছিল।’
তবে খাদ্যাভ্যাসে অনিয়ম, পার্টিতে মজে যাওয়া এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণির মানুষের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে কোহলি একসময় ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিলেন নিজের স্বপ্নপূরণের পথ থেকে। ২০১২ সালে বাজে এক আইপিএল মৌসুম কাটানোর পর বোধোদয় ঘটে কোহলির, বুঝতে পারেন অধঃপতনের পথে যাত্রা শুরু হয়েছে তাঁর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করেন যা করছেন তা কি ঠিক। সেইদিন থেকে পুরোপুরি বদলে যান কোহলি। খাবারদাবারে পরিবর্তন আনেন, বাড়িয়ে দেন নেটে পরিশ্রমের মাত্রা।
শচীন টেন্ডুলকারের প্রসঙ্গ যখনই আসে, তখনই যেন বাচ্চা ছেলের মতো ক্ষুদে ভক্ত হয়ে ওঠেন কোহলি। ক্রিকেট থেকে অবসর নেবার সময় শচীনকে এক বিশেষ উপহার দিয়েছিলেন কোহলি।
তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে কেমন প্রভাব ফেলেছিল সে , এটা বুঝানোর জন্য আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটি উপহার দিয়েছিলাম তাঁকে। এটা ছিল একটা সুতো, যেটা আমার বাবা আমাকে দিয়েছিলেন সব সময় সাথে রাখতে। আমি সব সময় সুতাটা আমার ব্যাগে রাখতাম। আর আমার বিশ্বাস এর চাইতে দামি কিছু আমি কখনোই তাঁকে দিতে পারতাম না।’