ধৈর্যই ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের বড় শক্তি। ইয়ান হিলি, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সের কারণে ক্যারিয়ারের সেরা সময়টাতে পাননি জাতীয় দলে খেলার সুযোগ। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি, চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে। ক্রিকেটবিধাতাও হতাশ করেননি, পরিশ্রমের সবটা ফিরিয়ে দিয়েছেন সুদে-আসলে। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় ডাক পেলেও যতদিন খেলেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন হলুদ জার্সিটাকে। তিনি ব্র্যাড হ্যাডিন, গিলক্রিস্ট পরবর্তী যুগে উইকেটের পেছনে অজিদের মূল ভরসা।
নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্ম হলে বারো বছর বয়সেই পরিবারের সাথে চলে যান কুইনবিয়ানে। ক্রিকেট খেলার শুরটা সেখান থেকেই। ১৬ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়ে যান অস্ট্রেলিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির হয়ে খেলার। ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেকটা আরেকটু পরে, ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে মিউচুয়াল কাপে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। চার নম্বরে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৬ রান করে আউট হলেও উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে জানান দিয়েছিলেন নিজের কার্যকারীতার।
পরের ম্যাচেই খেলেন ১৯ বলে ২৪ রানের ইম্প্যাক্টফুল এক ইনিংস। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকটা অবশ্য রাঙিয়েছিলেন দারুণভাবেই, খেলেছিলেন ৫৪ এবং ৩৩ রানের দারুণ দুটো ইনিংস। তবে আউট হয়েছিলেন ম্যাথু হেইডেনের বলে, যিনি কিনা পুরো ক্যারিয়ারে বলই হাতে নিয়েছেন কালেভদ্রে দুয়েকবার।
ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ খেলার সুবাদে জাতীয় দলে অভিষেকটা হয় দ্রুতই। ২০০১ সালে কার্লসন সিরিজের ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক হলেও সে ম্যাচে তেমন আলো ছড়াতে পারেননি, আউট হন মাত্র ১৩ রান করেই।
ততদিনে ইয়ান হিলি অবসর নিলেও উইকেট কিপিং নিয়ে ভাবতে হয়নি অস্ট্রেলিয়াকে। কারণ চলে এসেছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, যিনি কিনা হিলির চাইতেও ভাল ব্যাটিং করেন। তাঁর আক্রমণাত্নক ব্যাটিং যেন অন্য মাত্রা যোগ করে অজি ব্যাটিং লাইন আপে। ফলে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যান হ্যাডিন। তবে হাল ছাড়েননি, নিজেকে সবসময় তৈরি রেখেছেন।
যেন জাতীয় দলের প্রয়োজন হলেই নিজের সর্বোচ্চটা দিতে পারেন। অবশেষে সাত বছর পর ২০০৮ সালে গিলি অবসরে গেলে জাতীয় দলে আবারও ডাক পড়ে হ্যাডিনের। অবশেষে ৩০ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার ৪০০তম টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অভিষেক হয় তাঁর। এবার আর নিজেকে প্রমাণ করতে সময় নেননি, সে বছরেরই ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ক্যারিয়ার সেরা ১৬৯ রানের ইনিংস।
এরপর সময় যত গড়িয়েছে, হ্যাডিন তত স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল হয়েছেন। ২০১৩-১৪ অ্যাশেজে দলকে জেতানোর পেছনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেবার ৬১.৬২ গড়ে করেছিলেন ৪৯৩ রান। ব্যাট হাতে ছিলেন অসাধারন ধারাবাহিক, আট ইনিংসের মাঝে পাঁচ ইনিংসে ফিফটির পাশাপাশি এক ইনিংসে পেয়েছিলেন সেঞ্চুরির দেখা। তাঁর আগের অ্যাশেজেও ছিলেন দারুণ ফর্মে, দল হারলেও নিজে করেছিলেন ৩৬০ রান।
কেবল উইকেট কিপার কিংবা ব্যাটার হিসেবেই নয়, স্লেজার হিসেবেও কুখ্যাতি ছিল হ্যাডিনের। প্রতিপক্ষের ব্যাটারদের কথার আগুনে রীতিমতো জ্বালিয়ে মারতেন। ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন কিউই ব্যাটার গ্র্যান্ট ইলিয়টের সাথে।
যদিও ফাইনাল জিতে সেবার শেষ হাসিটা হেসেছিলেন হ্যাডিনই। ২০১৫ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জিতেই বিদায় নেন সাদা বলের ক্রিকেট থেকে। এই ফরম্যাটে ১২৬ ম্যাচ খেলে তাঁর সংগ্রহ ৩,১২২ রান। ১৬ ফিফটির পাশাপাশি দুবার পেয়েছেন সেঞ্চুরির দেখাও। তবে শেষের দিকে নামার কারণে খুব বেশি বল খেলার সুযোগ পেতেন না তিনি। একারণে তাঁর বড় ইনিংসের সংখ্যাও কম।
তবে লাল বলের ক্রিকেটে তাঁর বিদায়টা সুখকর হয়নি। ২০১৫ অ্যাশেজের সময় মেয়ের অসুস্থতার কারণে নাম সরিয়ে নেন দ্বিতীয় টেস্টের দল থেকে। কিন্তু এই ঘটনাটা ভালোভাবে নেননি তখনকার কোচ ড্যারেন লেহম্যান। তাঁর বদলি হিসেবে নামা গ্যারি নেভিল ভাল করলে হ্যাডিনের জন্য জাতীয় দলের দরজা বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটাররা সে সময় নিন্দা জানিয়েছিলেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার এহেন সিদ্ধান্তে। এরপর আর কখনোই জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাননি তিনি। ৬৬ টেস্ট খেলে এই ফরম্যাটে চার সেঞ্চুরি এবং ১৮ হাফ-সেঞ্চুরিতে তাঁর সংগ্রহ ৩,২৬৬ রান।
মাঠে ছাড়লেও ক্রিকেটকে সব সময় মনের মাঝে লালন করে গিয়েছেন হ্যাডিন। ক্রিকেটই তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান। তাই তো ২০১৭ সালে যোগ দেন অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলের ফিল্ডিং কোচ হিসেবে। খেলোয়াড়ি জীবনেও কখনও প্রচারের আলোয় আসেননি, নিজের কাজটা করে গিয়েছেন নীরবেই। কোচ হিসেবেও এখন গ্রিন-ম্যাক্সওয়েলরা যখন লুফে দেন দারুন সব ক্যাচ, তখন হয়তো আড়ালেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে হ্যাডিনের।