আমরা তখন লিওনেল মেসির অপেক্ষায় আছি।
মূল সূচিতে লেখা ছিলো, মেসি একদিন সংবাদ সম্মেলনে আসবেন। প্রথম দিন এলেন ‘বৃদ্ধ’ কোচ। পরের দিন এলেন পাবলো জাবালেতা। ফলে তৃতীয় সংবাদ সম্মেলনে মেসির আসাটা নিশ্চিত। সেটা ধরে নিয়ে সেদিন সংবাদ সম্মেলনে উপচে পড়া ভিড়। পেছনের দরজা থেকে কাউকে ঢুকতে দেখলেই মনে হচ্ছে, এই বুঝি মেসি এলেন।
অনেক অপেক্ষার পর দেখা গেলো তার মুখ। হ্যাঁ, সেই কমেডিয়ান টাইপের ভাবমূর্তির প্রায় ‘বৃদ্ধ’ কোচ।
তিনি ইংরেজি বলতে পারেন না। স্প্যানিশও বলেন আর্জেন্টিনার স্থানীয় উচ্চারণে। দোভাষীও তার কথা প্রায়শ বুঝতে পারেন না। এই যোগাযোগের দারুণ সমস্যার মধ্যেও তিনি একটু বিব্রত হেসে বললেন, ‘আমি জানি আপনারা মেসির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি তার মতো খেলতেও পারি না। তার মতো সুন্দরও নই। তারপরও আমাকেই সহ্য করতে হবে আপনাদের।’
হ্যা, তিনি আলেসান্দ্রো সাবেলা বা সাবেইয়া।
সেতিদন আমরা নিশ্চিত করেই বুঝতে পারিনি যে, আর্জেন্টিনার ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে কুশলী কোচদের একজনকে আমরা সামনাসামনি দেখতে পেয়েছি। আমাদের সৌভাগ্য যে, এই মানুষটির সাথে কয়েক দফা কথা বলতে পেরেছি, হাত মিলিয়েছি। আমরা না জেনেই সেদিন লিওনেল মেসিকে সবচেয়ে বেশি বুঝতে পারা মানুষটির ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম।
সেই সাবেলা আর নেই। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত কিছুদিন আইসিইউতেও ছিলেন। লড়ছিলেন জীবনের জন্য। শেষ রক্ষা হয়নি। মূলত হৃদযন্ত্রের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে তাকে আইসিইউতে নিতে হয়। শেষ দু দিন ভেন্টিলেশনে ছিলেন। অবশেষে দুনিয়া ছেড়ে শেষ পাড়ি দিলেন। এই ক দিন আগে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা চলে গেলেন। এবার তার উত্তরসুরী সাবেলাও চললেন।
সাবেলার সেরা পরিচয় নিশ্চয়ই তিনি ২০১৪ সালের ফাইনালিস্ট আর্জেন্টিনা দলের কোচ। তবে তার অন্যান্য পরিচয়ও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
খেলোয়াড়ী জীবনে মিডফিল্ডার ছিলেন। রিভারপ্লেটেই ক্যারিয়ারের বড় সময় কাটিয়েছেন। এরপর ইংল্যান্ডে এসে চার বছর খেলেছেন। ফিরে গিয়ে এস্তুদিয়ান্তেসে আবার লম্বা সময় কাটিয়েছেন। ছোট দুটি ক্লাবে খেলার পর ১৯৮৯ সালে পেশাদার খেলার জীবনের ইতি টানেন।
এর মধ্যে আর্জেন্টিনা দলেও খেলেছেন। ১৯৮৩-৮৪ সালে ৮টি ম্যাচে আর্জেন্টিনা দলের জার্সি গায়ে চড়িয়েছেন। জাতীয় দলের ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয়নি।
রিভারপ্লেট ও জাতীয় দলে খেলতে গিয়ে তাঁর জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন ড্যানিয়েল প্যাসারেলা। আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জেতা এই অধিনায়কের সাথে সাবেলার বন্ধুত্ব ছিলো গল্পগাথার মতো। দু জনে যা করতেন, এক সাথেই করতেন। খেলা ছাড়ার পর তাই দ্রুতই সাবেলা বন্ধুর সাথে যোগ দিলেন কোচিংয়ে। প্যাসারেলা তখন মাত্রই প্রথম কোনো বড় দলের দায়িত্ব নিয়েছেন। সেই রিভারপ্লেটে বন্ধুর সহকারী হিসেবে যোগ দিলেন সাবেলা।
এরপর দু’জন একসাথে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত।
এই জুটি পারমা, মন্টেরি, করিন্থিয়াসে কাজ করেছেন একসাথে। আর্জেন্টিনা ছাড়াও উরুগুয়ে দলেও দায়িত্ব পালন করেছেন জুটি বেধে। মজার ব্যাপার হলো, সাবেলা এর মধ্যে অনেকবার বিভিন্ন ক্লাবে প্রধাণ কোচ হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু বন্ধুকে ছেড়ে যাননি।
২০০৭ সালে রিভারপ্লেটে দায়িত্ব পালনের ভেতর দিয়ে শেষ হয় প্যাসারেলা-সাবেলা জুটির অধ্যায়। এরপর প্যাসারেলা আর শীর্ষ পর্যায়ে কোচিং করাননি। আর এখান থেকে নিজের জীবন শুরু করেন সাবেলা। এস্তুদিয়ান্তেসের দায়িত্ব নিয়েই তাদের কোপা লিবার্তোদোরেস জেতান। ক্লাব বিশ্বকাপ ফাইনালে বার্সেলোনার বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে ম্যাচ হারেন।
এস্তুদিয়ান্তেসের দায়িত্ব ছেড়েছিলেন একটা অভিমান নিয়ে। খেলোয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিলো বলে সরে এসেছিলেন। তিনি আর্জেন্টিনাই ছেড়ে যাচ্ছিলেন। আরব আমিরাতের আল-জাজিরা ক্লাবের সাথে কথা চলছিলো। কিন্তু এই সময় আর্জেন্টিনা দলের ডাক চলে এলো।
২০১১ কোপা আমেরিকার ব্যর্থতার পর আর্জেন্টিনার ফুটবল ফেডারেশন সিদ্ধান্ত নিলো ঘরোয়া ফুটবলের এই লিজেন্ডকে দেওয়া হবে জাতীয় দলের দায়িত্ব। আর এখানেই সাবেলা নিজের এক অসাধারণ রূপ তুলে ধরলেন।
অধুনা আর্জেন্টিনার যে কোনো কোচের সামনে সমস্যা থাকে দুটি –
- মেসির সর্বোচ্চ ব্যবহার কিভাবে করা যাবে।
- ভঙ্গুর ডিফেন্সকে কিভাবে আগলে রাখা যাবে।
সাবেলা প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে এই সমস্যার একটা সমাধান বের করলেন। তিনি মেসিকে সর্বোচ্চ স্পেস দিয়ে তাকে আক্রমণভাগের সত্যিকারের নেতা করে তুললেন। সেই সাথে হ্যাভিয়ের মাশচেরানোকে কেন্দ্র করে মাঝ মাঠ থেকে নিচের দিকে এক দূর্গ গড়ে তুললেন।
আর্জেন্টিনার কোচদের একটা চিন্তা থাকে যে দলে মেসি, আগুয়েরো, হিগুয়েন, ডি মারিয়া আছেন বলে দলকে প্রতি ম্যাচে অলআউট অ্যাটাকিং ফুটবল খেলতে হবে। এই জায়গা থেকে বের হয়ে এলেন সাবেলা। এই দূরন্ত আক্রমনভাগ থাকার পরও তিনি প্রতিপক্ষ বিবেচনায় কখনো কখনো রক্ষনকে প্রধাণ কৌশল করলেন। রীতিমতো কাউন্টার অ্যাটাক নির্ভর ম্যাচও খেলেছেন সাবেলা।
আর এই পরিস্থিতি ও প্রতিপক্ষ বিবেচনায় খেলাটা আর্জেন্টিনাকে দারুণ সফল করে তুললো। আর্জেন্টিনা জিতলে ৬ গোলে জিতবে, নইলে হারবে; এটা সাবেলার তত্ত্ব ছিলো না। তার ধারণা ছিলো যে, এক গোলের হলেও জয় চাই। এই রেজাল্ট ওরিয়েন্টেড ফুটবল আর্জেন্টিনাকে ২০০২ সালের পর প্রথম ধারাবাহিকস করে তুললো। এবং তারা ১৯৯০ সালের পর প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনাল খেললো।
ফাইনালে প্রতিপক্ষ ছিলো জার্মানি। যারা আগের ম্যাচেই ব্রাজিলকে ৭ গোল দিয়ে এসেছে। সাবেলা এই জার্মানিকেও নবীশ এক ডিফেন্স লাইন দিয়ে আটকে রাখলেন। সেই সাথে নিজের দলকে অন্তত তিনটি পরিষ্কার সুযোগ তৈরী করতে দেখলেন। কিন্তু প্যালাসিও, হিগুয়েন ও মেসি সেই সুযোগ তিনটি থেকে গোল করতে পারলেন না। পাল্টা আক্রমনে আর্জেন্টিনা বরং গোল হজম করে ফেললো। ফলে সাবেলার রূপকথা লেখা হলো না।
আর এখানেই সাবেলা বিদায় বলে দিলেন। তিনি ব্যর্থতার ইতিহাস বইতে রাজী নন।
সাবেলা এরপর আর উল্লেখযোগ্য কোনো দলের দায়িত্ব পালন করেননি। ফুটবলের চলতি ইতিহাস থেকে যেনো হারিয়েই গিয়েছিলেন। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন এই আলোর দুনিয়া থেকে।
কিন্তু সাবেলার ছাপ ফুটবল ইতিহাসে থেকে যাবে। সাবেলাকে বাইরে থেকে দেখে অনেক সময় একজন কর্মহীন অলস ভাড় বলে মনে হতো। কখনো বুকে বল লাগলে অভিনয় করে পড়ে যাচ্ছেন, হাসির সময়ও ইচ্ছে করে মুখ কালো করে রাখছেন; খেলোয়াড়ই তার মুখে পানি ছেটাচ্ছে। কিন্তু তিনি ভাড় নন; তিনি এক চিন্তাবিদ। তাকে কেউ আদর করে ম্যাজিশিয়ান বলে ডাকতো, খেলাকে ধীরগতির করে ফেলার জন্য কেউ বলতো-স্লথ। সে আপনি যে নামেই মনে রাখেন, সাবেলা যে ছিলেন, এটা আপনাকে মনে রাখতেই হবে।