প্রতিবেশী ভারতের তুলনায় ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার পরাশক্তি হয়ে ওঠা বেশ দেরিতে। ভারত যেখানে ১৯৮৩ সালেই স্বাদ পেয়েছি বিশ্বকাপ জেতার, শ্রীলঙ্কার সেখানে বিশ্বকাপ জেতা ঘরের মাঠে ১৯৯৬ সালে। ফলে এই শতাব্দীর শুরুর দিক থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তিদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করেছে লঙ্কানরা। তবে ২০০০ সালে কোকা কোলা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে লংকানরা ভারতকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছিল, ২৪৫ রানের বিশাল ব্যবধানে হারিয়ে চমকে দিয়েছিল পুরো বিশ্ববাসীকে।
সেবার আরব আমিরাতে কোকা কোলা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দুই প্রতিবেশী ভারত এবং শ্রীলঙ্কা। টুর্নামেন্টের আরেক দল জিম্বাবুয়ে বিদায় নিয়েছিল কোনো ম্যাচ না জিতেই। গ্রুপ পর্বের দুই ম্যাচেই শ্রীলংকার কাছে হারলেও ফাইনালে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলবে ভারত এমনটাই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু জয়াসুরিয়া-মুরালিদের সামনে সেদিন বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেননি শচীন-সৌরভরা।
টস জিতে শুরুতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন শ্রীলঙ্কান কাপ্তান সনাথ জয়াসুরিয়া। নিজের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্যই যেন শুরু থেকেই আক্রমণাত্নক ব্যাটিং শুরু করেন। তাঁর মারমুখী ব্যাটিংয়ের কোনো জবাব ছিল না জহির খান, অজিত আগারকারদের কাছে। যদিও মাঝে টানা কালুভিতারানা, আতাপাত্তু এবং জয়াবর্ধনের উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন জহির এবং সুনীল যোশি।
এক পর্যায়ে ১১৬ রানেই টপ অর্ডারের চার উইকেট হারিয়ে ফেলে লঙ্কানরা। যদিও একপ্রান্তে তখনো ছিলেন জয়াসুরিয়া, উইকেটে তাঁর সাথে এসে জুটি বাঁধেন রাসেল আর্নল্ড। একপাশে ধীরস্থির রাসেল। অন্যপ্রান্তে মাতারা হারিকেনের ঝড়, দুয়ে মিলে তরতর করে এগিয়ে যায় লঙ্কান রানের চাকা। তাঁদের জুটি থামাতে না পেরে ভারতীয় অধিনায়ক গাঙ্গুলি সেদিন ব্যবহার করেছিলেন আটজন বোলার।
যদিও তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি,ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে ইনিংস শেষ হবার দুই ওভার আগে গাঙ্গুলির বলেই আউট হন জয়াসুরিয়া। যদিও তাতে বিশেষ উপকার হয়নি, লংকানরা ততক্ষণে পেয়ে গেছে তিনশো ছুঁইছুঁই সংগ্রহ। ১৬১ বলে ২১ চার এবং চার ছক্কায় ১৮৯ রান করে আউট হন তিনি, অন্যপ্রান্তে রাসেল অপরাজিত থাকেন ৫২ রানে। জয়াসুরিয়ার সেই ইনিংস ছিল ততদিন পর্যন্ত ওয়ানডে ক্রিকেটে যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের ইনিংস।
ভারতের সামনে জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ৩০০ রানের। ক্রিকেটের একদম আদিলগ্ন থেকেই ভারত জনপ্রিয় তাঁদের লম্বা ব্যাটিং লাইন আপের কারণে। সেই ম্যাচেও সবাই ভেবেছিল বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে শক্ত জবাব দেবে ভারতীয়রা। সৌরভ-শচীনের উদ্বোধনী জুটি ছাড়াও যুবরাজ সিং, হেমাং বাদানি, বিনোদ কাম্বলিরাও ছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যান।
কিন্তু, পরের ঘন্টাদুয়েকে যা ঘটে তাঁর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউই, পুরো বিশ্ববাসী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। চামিন্দা ভাসের তোপে পড়ে দুই অংকের ঘরের পৌঁছানোর আগেই সাজঘরে ফেরেন টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যান। দলীয় সংগ্রহ বিশ রানে পৌঁছানোর আগেই পথ হারানো ভারতের লেজ গুটানোর পরের দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন মুত্তিয়া মুরালিধরন।
ভাসের পাঁচ উইকেট এবং মুরালির তিন উইকেটে ইনিংসের অর্ধেক ফুরোনোর আগেই মাত্র ৫৪ রানেই গুটিয়ে যায় ভারতীয়রা। একমাত্র রবিন সিং বাদে দুই অংকের ঘরে পৌঁছুতে পারেননি কোনো ব্যাটারই। ততদিন পর্যন্ত শারজাতে সেটাই ছিল সর্বনিম্ন দলীয় রানের সংগ্রহ এবং বিশ্ব ক্রিকেটে তৃতীয় সর্বনিম্ন রানের সংগ্রহ।
জয়াসুরিয়ার ব্যাটিংয়ের পর ভাস আর মুরালির ব্যাটিংয়ের কোনো জবাব ছিল না ভারতীয়দের মধ্যে। তবে সবাই ভুলে যান নুয়ান জয়সার কথা, ভাসের পাশাপাশি অন্যপ্রান্ত থেকে আক্রমণাত্নক বোলিং করে ভারতীয় ব্যাটারদের চাপে রাখেন তিনি।
সত্যি বলতে জয়াসুরিয়ার সেই ইনিংসই ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটারদের। ম্যাচ পরবর্তী সম্মেলনে গাঙ্গুলির কথাতেও ফুটে উঠেছিল সেই হতাশা, ‘আমরা এক পর্যায়ে ১১৬ রানেই ওদের চার উইকেট তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর সনাথ দুর্দান্ত ব্যাটিং করে এবং আমাদের ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয়। ম্যাচ জয়ের সমস্ত কৃতিত্ব সে-ই পাবে।’
সেরা ব্যাটার, সেরা ফিল্ডার, দ্রুততম ফিফটি, সর্বোচ্চ ছয়, ম্যান অব দ্য ম্যাচের পাশাপাশি টুর্নামেন্ট সেরা খেতাবও জিতে নেন তিনি। তবে শ্রীলঙ্কা সেদিন খেলেছিল দল হয়েই। তাঁদের দলগত নৈপুণ্যের সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি তারকানির্ভর ভারত। সেদিনের সেই ম্যাচটার স্মৃতি বোধহয় ভুলে যেতেই চাইবেন মাঠে থাকা ভারতীয় ক্রিকেটার-সমর্থকরা।