সেদিনের খালিস্তানি আজ ভারতের নায়ক

এবারের এশিয়া কাপে ক্যাচ মিসের ঘটনা ঘটেছে ২৮ বার। এর মাঝে একদম সহজ সুযোগ মিস হয়েছে আটবার। তাদের কাউকে দোষারোপ করা না হলেও ভারতের আর্শদ্বীপ সিংয়ের ঘটনাটা ভিন্ন। তিনি যে পাকিস্তানের বিপক্ষে ক্যাচটা ফেলে দিয়েছিলেন! এমন না তিনি ক্যাচ ধরলেই ভারত ম্যাচ জিতে যেত। তবু ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুন্ডুপাত করা হয়েছে আর্শদ্বীপের।

কেবল তিনি একা নন, টেনে আনা হয়েছে তার স্বজাতি পাঞ্জাবিদেরও। ধর্মে শিখ আর্শদ্বীপকে রীতিমতো খালিস্থানি বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অথচ দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কানাডা না গিয়ে এই পেসার বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেটার হওয়ার বন্ধুর পথ। হয়তো গুটিকয়েক অন্ধ সমর্থকই এমনটা বলেছেন, তবুও সেটা আর্শদ্বীপের কয়েক রাতের ঘুম কেড়ে নেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ম্যাচেই বদলে গিয়েছিল তার জীবন।

তবে ভারতীয় ক্রিকেটে এমন ঘটনা প্রথম নয়। গত বছরও পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ওভারে বেশি রান হজম করায় মোহাম্মদ শামিকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হোক দাবি তুলেছিলেন সমর্থকরা। অথচ সেদিন ভারতীয় ব্যাটাররাও ছিলেন সমান ব্যর্থ।

এক বছর বাদে আর্শদ্বীপ এবং শামি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ভারতের বোলিং লাইন আপ। বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে দুজনের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে অল্প রানেই গুটিয়ে যায় পাকিস্তান। সেদিন নতুন বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন আর্শদ্বীপ। অথচ অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আগে কখনও খেলা হয়নি এই পেসারের। প্রস্তুতি ম্যাচের সময় ছিলেন পার্থেই। সিনিয়র ভুবনেশ্বর কুমারই সুযোগ পেয়েছিলেন প্রথম ওভার করার। এরপরই বোলিংয়ে এসে ডিপ থার্ড এবং ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগে ফিল্ডার রেখে বল শুরু করেন বাঁ-হাতি আর্শদ্বীপ।

বাবর আজমের শর্ট বলের দুর্বলতা কারোরই অজানা নয়। আর্শদ্বীপ ফিল্ডারও রেখেছিলেন সে অনুযায়ী। শর্ট বল আসছে জানলেও, কেউই জানতেন না কখন আসছে সেটা। অবশ্যই প্রথম বলে না, তাহলে কখন? প্রথম বলেই ইনসুংগার ডেলিভারি করলেন আর্শদ্বীপ। বাবর সামনে এগিয়ে খেলতে চাইলেও রক্ষা হলো না, প্রথম বলেই সাজঘরে ফিরলেন পাকিস্তান অধিনায়ক।

নতুন ব্যাটসম্যান এসে ওভারটা ভালোভাবে কাটালেও পরের ওভারে আর বাঁচতে পারলেন না মোহাম্মদ রিজওয়ান। শর্ট বল সামলাতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন ভুবনেশ্বর কুমারের হাতে। বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই ব্যাটসম্যান কাবু হলেন উঠতি এক পেসারের হাতে। দু:স্বপ্নের এক মাস কাটিয়ে বিশ্বকাপে স্বপ্নের মত এক শুরু পেলেন আর্শদ্বীপ সিং।

‘অসাধারণ এক অনুভূতি। অনেক বেশি ভালোবাসা পেয়েছি’ – আর্শদ্বীপ বলেছিলেন ম্যাচের পর। হ্যাঁ, তার সতীর্থরা বরাবরই তাকে ভালোবেসে গিয়েছেন। পিঠে হাত রেখে সাহস জুগিয়েছেন, ভরসা রেখেছেন তাঁর উপর। নিজের পরিকল্পনামাফিক বল করার স্বাধীনতা তাঁকে দিয়েছেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা। টানা দুই-তিনটা ইনসুইঙ্গারের পর একটা শর্ট বলে চমকে দিয়েছেন ব্যাটারকে।

তাঁর ভাষায়, ‘আমি ঠিকভাবে পরিকল্পনা করে গিয়েছিলাম, জানতাম কখন শর্ট বল করতে হবে। কোচিং স্টাফরা আগেই জানিয়েছিল অস্ট্রেলিয়াতে বেশ ভাল বাউন্স পাব। আমাকে কেবল সঠিক জায়গায় বলটা ফেলতে হত। তাছাড়া বল করার সময় ডিপ স্কয়ার লেগের বড় বাউন্ডারির কথাও মাথায় ছিল।’

তিনি জানেন প্রতিদিন সফল হবেন না। হয়তো পরের ম্যাচেই টপএডজ হয়ে ছয় হয়ে যাবে। ভাগ্যিস সেদিন হাতে গিয়েছিল, আর্শদ্বীপ হাসেন আপন মনেই। তবে তিনি কখনও রক্ষণাত্নক বোলিং করেন না, তাঁর ভাবনায় সব সময়ই উইকেট তুলে নেবার চিন্তা। শাহিন শাহ আফ্রিদি তাঁকে ছয় মেরেছেন, পরের বলেই ফিরে এসেছেন তিনি।

আর্শদ্বীপের বোলিং কোচ পরশ মামব্রে। অনেকদিন ধরেই কাজ করেছেন তাঁর রানআপ ঠিক করতে এবং বল দুই দিকেই সুইং করানো আয়ত্ত্ব করাতে। লক্ষ্য করেছেন আর্শদ্বীপের দৃষ্টি এড়ায় না ছোটখাটো কোনো জিনিসও।

মামব্রে বলেন, ‘সে কথা বলতে ভীষণ পছন্দ করে এবং সিনিয়রদের কাছে থেকে প্রতিনিয়ত শেখার চেষ্টা করে। ভুবনেশ্বর এবং শামির সাথে সারাক্ষণ কথা বলে সে, কারণ তাঁরা দুজনেই এখানে ম্যাচ খেলেছেন।’ মামব্রে আরও বলেন, ‘আলোচনা করা নতুন জিনিসগুলোই আর্শ্বদীপ ম্যাচে প্রয়োগের চেষ্টা করে। আমি এই কৃতিত্বটা তাঁকেই দেব। কথা বলে শিখে সেটা মাঠে প্রয়োগ করা মোটেই সহজ কোনো ব্যাপার নয়। এভাবেই দক্ষ হয়ে উঠতে হয়।’

অথচ এবারের বিশ্বকাপে একাদশে সুযোগ পাবার কথা ছিল না তাঁর। শেষ মূহুর্তের ইনজুরিতে জাসপ্রিত বুমরাহ ছিটকে গেলে ডেথ ওভারে বল করায় দায়িত্ব এসে বর্তায় আর্শ্বদীপের কাঁধে। ২০২১ সাল থেকে টি-টোয়েন্টিতে ডেথ ওভারে চতুর্থ সেরা ইকোনমির রেকর্ড এখন তাঁর দখলে। টি-টোয়েন্টি ইয়র্কার দেয়ার ক্ষেত্রে বোলাররা ভয়ে থাকেন যদি না হাফভলি কিংবা ফুলটস হয়ে যায়। এখানেও সফল তিনি, মাত্র দুজন বোলার তাঁর চেয়ে বেশিবার ইয়র্কারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন এই সময়ে। বাঁ-হাতি কিংবা ডানহাতি দুই ধরনের ব্যাটসম্যানের বিপক্ষেই সমান সফল এই পেসার।

এবারের গ্রীষ্মে অস্ট্রেলিয়াতে বেশ পরিবর্তন দেখেছে ক্রিকেটবিশ্ব। বল আগের চেয়ে বেশি সুইং করেছে, গরমের তীব্রতা কমেছে। নতুন বলে আর্শদ্বীপ দুই দিকেই সুইং পেয়েছেন। ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় তাঁকে দলে পেয়ে নিজেদের রীতিমতো ভাগ্যবান ভাবছেন।

তিনি বলেন, ‘আপনি যদি আমাকে গত নভেম্বরের কথা বলেন, তবে বলবো আর্শদ্বীপ আমার নোটবুকে ছিল। সে দুর্দান্ত এক আইপিএল মৌসুম কাটিয়েছিল। কিন্তু তারপর বেশ বড় একটা পথ সে পাড়ি দিয়েছে, জাতীয় দলে সুযোগ করে নিয়েছে। নিজের যোগ্যতার জানান দিয়ে নিজেকে একাদশের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছেন। তাঁর মত বোলারকে দলে পাওয়া আশীর্বাদ।’

বাংলাদেশের বিপক্ষে বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে বল যেখানে বারবার ভিজে যাচ্ছিল, বল গ্রিপ করা হয়ে যাচ্ছিল দু:সাধ্য। বাংলাদেশের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছিলেন মাঠ খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত না। জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল নয় ওভারে ৮৫ রান, হাতে দশ উইকেট। সেমিতে উঠতে ম্যাচটা জিততেই হত ভারতকে, আর্শদ্বীপ সেই চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন।

অথচ সেই ম্যাচের শুরুটা বাজে হয়েছিল তাঁর, প্রথম ওভারেই লিটন দাস তাঁকে বাউন্ডারি ছাড়া করেন তিনবার। তবে মহাগুরুত্বপূর্ণ ১২, ১৪ এবং শেষ ওভারে বল করতে এসে নিজের দক্ষতার জানান দেন তিনি। ১২তম ওভারে তুলে নেন দুই উইকেট। শেষ ওভারে বাংলাদেশের জয়ের জন্য ২০ রানের দরকার হলে বোলিংয়ে পুনরায় আগমণ ঘটে আর্শ্বদীপের। প্রথম বলেই দারুণ এক ইয়র্কারে বাংলাদেশি ব্যাটারের মনোবল গুঁড়িয়ে দেন। সেই ওভারে চারটি ইয়র্কার দিয়ে ভারতকে এনে দেন পাঁচ রানের স্বস্তির এক জয়।

যখন তাঁর মা সাইকেলে করে তাঁকে ক্রিকেট মাঠে পৌঁছে দিতেন, বেশিরভাগ সময়ই আর্শদ্বীপ সাইকেলে বসেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিতেন। জনপ্রিয় হওয়ার আগে, প্রতিদিনই চন্ডিগড় পার্কে দৌড়াতেন ফিটনেস ঠিক রাখতে। আর্শদ্বীপ জানেন খারাপ করলে ভক্তরা তাঁকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে দুবার ভাববে না। তাই তিনি আজও পরিশ্রম করে যান আগের মতোই। সেদিনের সেই খালিস্তানি ছোকরার উপর আজ পুরো ভারতের বিশ্বকাপ স্বপ্ন। মাত্র এক মাসেই বদলে গিয়েছে আর্শদ্বীপের দুনিয়া। ভিলেন থেকে নায়ক হবার লড়াইয়ে তিনি পেয়েছেন ভালোবাসা, শিক্ষা এবং পরিশ্রম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link