যুবরাজকীয়

গতিশীল মহাবিশ্ব। সমাজও প্রগতিশীল। অসীম মহাশূন্যে কোটি কোটি গ্রহ, নক্ষত্রের মেলা। এরই মাঝে যে যার কক্ষপথে নিত্যযাত্রী। ধরিত্রীও চির-চলিষ্ণু তার নিজ কক্ষপথে। এরই মাঝে পৃথিবীর ক্রিকেটদ্বারে তথা ভারতীয় ক্রিকেটের প্রবেশদ্বারে আগমন এবং প্রস্থান যুবরাজ সিংয়ের।

ক্রিকেটের মঞ্চে ভয়াল শেবাগ-শচীন কিংবা শচীন-সৌরভের তিরোভাবের পর আরেক রুদ্রমূর্তি যুবরাজ সিং-এর আবিভার্ব ঘটতো। প্রারম্ভিক উইকেট পতনের অবগুণ্ঠনে মুখ ঢেকে থাকা ভারতীয় জনজীবন আবারও মাথা বের করে স্বপ্ন দেখতো। যুবরাজের ব্যাটের স্পর্শে তাবড় তাবড় বোলারদের ঘুম ভাঙত। বাইশ গজের পিচে সোনার ব্যাটের স্পর্শে ভারতীয় ইনিংস সজ্জিত হতো নবরূপে, নব সাজে।

বারে বারে সীমানার ধারে আছড়ে পড়তো বল। কখনোও বা শরতের নীল আকাশে সফেদ মেঘের দূর দেশে পাড়ি দিত তাঁর হিট করা বলটি। সামান্য দূরে দর্শকমহল থেকে মধুর সুরে কিংবা বেসুরো গলায় চিৎকার উঠত, ‘যুবি… যুবি… যুবি।’ তাঁর রূপে, গুণে ভরে উঠত ভারতীয় ক্রিকেট।

২০০৩ সালের বিশ্বকাপের পরে কেটে গেল ঠিক চারটে বছর। সৌরভ সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। ওয়েষ্ট ইন্ডিজে দ্রাবিড়ের রণতরী মাঝ পথেই ডুবে গেছে। এমতাবস্থায় ধোনি এবং তাঁর তরুণ তুর্কিরা পাড়ি দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলার উদ্দেশ্যে। যুবরাজ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর ট্রাম্পকার্ড।

ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ, ২০০৭, পীযূষ চাওলার ক্যাচ মিসের খেসারত দিতে হলো যুবিকে। দিমিত্রি মাসকারেনহাস যুবরাজের এক ওভারে পরপর পাঁচটি ছক্কা হাঁকালেন। ঠিক ওই বছরই ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি ঘটল বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। স্টুয়ার্ট ব্রডের ছয় বলে পরপর ছ’খানা ছক্কা। সেমিফাইনাল প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। বড় বড় বিধ্বংসী বোলার সব। ব্রেট লি, নাথান ব্র্যাকেন, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক।

ঘণ্টায় ১৪৫ কিলেমিটার গতিবেগের বল স্টাম্প বরাবর আছড়ে পড়তেই ঈশ্বরিক এক ফ্লিক শটে তা স্পর্শ করে শূন্য আকাশের অবাধ বিচরণশীল বাতাসকে। শটে থাকে বৈচিত্রতা, ছক্কার বর্ষণ দেয় অপার শান্তি। ৫০ ওভারের হতাশার কালিমা মুছে দিয়ে সাফল্যের সাগরে স্নান করিয়ে দিয়েছিল সে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ চলাকালীন দেহে দানা বাঁধতে থাকে মারণ রোগ ক্যান্সার।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগের দিন চলতে থাকে রক্তবমি। রক্তের অগ্নিশিখায় জ্বলতে থাকা দেহ অতি নিমেষেই সেদিন পেরিয়ে গিয়েছিল রবি রামপল, কাইরেন পোলার্ডের দলকে। নব শিহরণ জাগিয়ে ফিরে এসেছিলেন যুবি, হাঁকিয়ে ছিলেন একটি সেঞ্চুরি। সেবার বিচিত্র এক ঐন্দ্রজালিক হয়ে ফিরেছিলেন তিনি। চিরযৌবন প্রাপ্ত যুবি নতুন ধারা জাগরিত করে তুলেছিল ভারতীয় ক্রিকেটে। ২৮ বছর আগের মুহূর্ত ফিরিয়ে এনেছিলেন পাঞ্জাবের এই ‘শের’।

বিশ্ববাসীর হৃদয় দ্বারে যুবরাজের এরূপ আবির্ভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। তাঁর ‘যুবরাজ’ নাম সার্থক। ভারতবর্ষের অন্যতম সেরা ফিল্ডার আর দুধ-ধোয়া রঙের রূপ কোন নারীর হৃদয়-মনকে নাড়া না দেয়? নয়ন ভোলানো এক রূপের ছটা। শীতঋতুর দেশে কুয়াশা হয়ে হানা দেয় সমগ্র বোলারের সভ্যতায় এবং গ্রীষ্মের রুদ্র মূর্তি ধারণ করে সবুজ গালিচায় ফিল্ডিংয়ের সময়। একরাশ দীর্ঘশ্বাসে হিমেল বাতাস ধারণ করে রওনা দেয় সাদা রঙের বলের দিকে আর ঈগলের ন্যায় উড়ে গিয়ে লুফে ন্যায় বিপরীত টিমের ব্যাটসম্যানদের ক্যাচ।

দিন গুনতে গুনতে কোনোও এক সময় মহাপ্রস্থান ঘটে গিয়েছিল যুবির। এক নিমেষে মাটিতে মিশে যায় তাঁর ওই হাসিমুখর মুখমণ্ডল। ইতিহাসের বুকে হারিয়ে যাওয়া যুবির দিকে তাকিয়ে ১৩০ কোটি ভারতবাসী স্বপ্ন বুনতে থাকে আবারও যদি তিনি ফিরে আসতেন। আবারও যদি কোহলি, রোহিত, বুমরাহদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে ক্রিকেটের গান গাইতেন তবে সমগ্র ভারতবাসী প্রাণের মণিকোঠায় আবারও সংগ্রহ করে রাখতো কভার ড্রাইভ, ফ্লিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link