ইংল্যান্ড নাকি পাকিস্তান, কোন দল এগিয়ে?

১৯৯২ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। সে বারের বিশ্বকাপ ফাইনালে পাকিস্তান-ইংল্যান্ড মহারণে তখন উত্তপ্ত মেলবোর্ন। পাক-ইংলিশদের লড়াইটা জমেছিলও বেশ। তবে ক্রমেই ইংলিশদের দিকে প্রায় ঝুঁকে যাওয়া ম্যাচটা নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে আনেন পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম।

এক ওভারেই অ্যালান ল্যাম্ব আর ক্রিস লুইসকে বোল্ড করে ইংলিশদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন ফিকে করে দেন এ বাঁ-হাতি পেসার। ওয়াসিম আকরাম সেই যে কিংবদন্তি হওয়ার পথে হেঁটেছিলেন, এরপর আরও প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি বল হাতে বিশ্বকে শাসন করেছিলেন।  

তিন দশক বাদে আবারও পাকিস্তান-ইংল্যান্ড ফাইনাল। কাকতালীয়ভাবে এবারের ফাইনালটাও সেই মেলবোর্নেই। ফরম্যাটটা যদিও টি-টোয়েন্টি। তারপরও মাঠের বাইরের ফিসফাসানিতে জিজ্ঞাসু মনে একটি প্রশ্নই ভেসে বেড়াচ্ছে-১৯৯২ সেই বিশ্বকাপের পুনরাবৃত্তি নাকি পুরনো ইতিহাসের দায় শোধ করবে ইংল্যান্ড?

আপাতত সে উত্তরের জন্য মঞ্চ প্রস্তুত। তবে বৃষ্টিও আড়ালে চোখ রাঙানি দিচ্ছে। ইংল্যান্ড-পাকিস্তানের লড়াইয়ে বাঁধা হয়ে আসতে পারে বেরসিক বৃষ্টি। মেলবোর্নের আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে তা আগেই জানা গিয়েছে। তবে ফাইনালের আগে আলোচনা তো আর থেমে নেই। সমর্থক থেকে শুরু করে কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মাঝে আলোচনা, সমালোচনা, বিশ্লেষণ চলছে দুর্দান্ত গতিতে। সেই আলোচনায় খেলা ৭১ ই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? কে এগিয়ে? ইংল্যান্ড নাকি পাকিস্তান? সে সব বিশ্লেষণ নিয়েই থাকছে ম্যাচ প্রিভিউ।   

সেমিফানালের ম্যাচে ইনজুরির কারণে ইংল্যান্ড একাদশে ছিল না ডেভিড মালান আর পেসার মার্ক উড। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে পাকিস্তানের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচে এ দুইজনকেই একাদশে দেখা যাবে। ভারতের বিপক্ষে সেমির ম্যাচে ব্যাটিংয়ের সবটাই করে এসেছিলেন দুই ওপেনার জশ বাটলার আর অ্যালেক্স হেলস।

তাই, মালানের অনুপস্থিতি খুব একটা ভোগায়নি ইংল্যান্ডকে। তবে মার্ক উড না থাকায় বোলিংয়ে বেশ ভুগতে হয়েছিল তাদের। বিশেষত, ডেথ ওভারে গিয়ে খুব একটা বিকল্প না থাকায় কিছুটা ঝামেলাতেই পড়তে হয়েছিল জশ বাটলারকে। তবে স্বস্তির খবর হল, ব্যাটিং অর্ডার কিংবা বোলিং লাইন আপ, মালান, উডের ফিরে আসাতে পূর্ণ শক্তির দল নিয়েই ফাইনালে খেলতে পারবে ইংল্যান্ড। 

এমনিতে এবারের আসরে বেশ ধারাবাহিকই ছিল ইংল্যান্ড। বৃষ্টি আইনের মারপ্যাঁচে পড়ে আইরিশদের কাছে তারা হেরেছিল বটে, তবে বাকি সব ম্যাচেই আধিপত্য দেখিয়েছে বাটলারের দল। আর ইংল্যান্ডের জন্য সবচেয়ে সুখকর ব্যাপার হল, ইংল্যান্ড একাদশের প্রায় সবাই ছন্দে আছেন, একই সাথে আগের প্রতিটি ম্যাচে কেউ না কেউ ম্যাচ জয়ে অবদান রেখেছেন। 

সেমিতে ওঠার ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অ্যালেক্স হেলসের ৩০ বলে ৪৭ রানের ইনিংস ইংল্যান্ডকে ম্যাচ জয়ের এগিয়ে দিয়েছিল। তবে মাঝে প্রয়োজন ছিল একটা ক্যালকুলেটিভ ইনিংস। সেটাই করেছিলেন বেন স্টোকস। তাছাড়া এর আগে, কিউইদের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ৪৭ বলে ৭৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন অধিনায়ক জশ বাটলার।

নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচটিও ছিল বাঁচা মরার লড়াই। ইংলিশরা সে ম্যাচটিও জিতেছিল বেশ অনায়াসেই। অর্থাৎ চাপের মুখে দুর্দান্ত খেলার একটা অভিনবত্ব আছে ইংল্যান্ডের এই দলটার মাঝে। যে কোনো পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পূর্ণ মানসিকতা সকল ক্রিকেটারের মাঝে আছে। আর এমন স্কোয়াড নিয়ে বাটলার নিজেও বেশ আত্মবিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করেন, নিজেদের দিনে তারা যেকোনো প্রতিপক্ষের জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। 

এবারের আসরে পাকিস্তানের শুরুটা হয়েছিল বেশ নড়বড়ে। প্রথম দুই ম্যাচ হেরে একদম ব্যাকফুটে পড়ে যাওয়া যেটাকে বলে। এমন পারফরম্যান্সে সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিল স্বয়ং পাকিস্তানের গ্রেটরাই। তবে সেই সমালোচনায় এক সময় প্রশংসা বাণে রূপ নিল। পাকিস্তান দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ালো। যদিও সেমিতে আসার জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল একটি ভাগ্য।

  আর সেই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় অবিশ্বাস্যভাবে সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে ফেলে পাকিস্তান। এমন সৌভাগ্যের পথযাত্রায় হয়তো আর থামতে চায়নি বাবর আজমের দল। সেমিতে কিউইদের হারিয়ে তারা নিশ্চিত করে ফাইনালও। আর এ ফাইনালের আগেই যেন পাকিস্তান দলের বদলে যাওয়া চেহারাটা আরও উজ্জলভাবে ফুটে উঠলো। 

পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে রান নেই, মোহাম্মদ রিজওয়ান, বাবরের ব্যাটে। সেমির আগ পর্যন্ত আত্মবিশ্বাস রয়েছে একদম তলানিতে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসে মহীয়ান হওয়ার জন্য তারা বেছে নিল নিউজিল্যান্ডকেই। বাবর-রিজওয়ান স্বরূপে ফিরলেন একদম মোক্ষম সময়ে। আর তাদের ফিরে আসাটা পাকিস্তান শিবিরে আসল স্বস্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে।

এ ছাড়া টুর্নামেন্টের মাঝপথে স্কোয়াডে সংযুক্ত করা হয়েছিল মোহাম্মদ হারিসকে। আর একাদশে এসেই বাজিমাত করে ফেলেন ২১ বছর বয়সী এ তরুন ব্যাটার। ক্লিন হিট আর স্ট্রাইক রোটেট করে প্রতি ম্যাচেই দুর্দান্ত ব্যাটিং করছেন তিনি। আর আরেক মিডল অর্ডার ব্যাটার ইফতেখার এবারের আসরেই হাঁকিয়েছেন দুটি ফিফটি। পাকিস্তানের মিডল অর্ডার নিয়ে আগে থেকেই অনেক প্রশ্ন ছিল। তবে এবারের আসরে এসে সেই ধারণা, মতামত কিংবা প্রশ্নের বিপরীতে কিছু একটা উত্তর বেরিয়ে এসেছে। পাকিস্তানের মিডল অর্ডার ব্যাটাররা বেশ ভালই করছেন।   

পাকিস্তানের পেস বোলিং লাইন আপ বরাবরই দুর্দান্ত। তবে টুর্নামেন্টের শুরুতে তাদের প্রধান অস্ত্র শাহীন আফ্রিদি ঠিক ছন্দটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু ফিরে আসতেও সময় নিলেন না। দুই ম্যাচ বাদেই নিজের ঝলকানি দেখানো শুরু করলেন। এখন এবারের ফাইনালে তাঁর মাঝে ৯২ এর সেই ওয়াসিম আকরাম ভর করে কিনা সেটিই দেখার পালা। তেমনটি হলে, ওয়াসিম আকরামের মতোই গ্রেটনেসের সুপ্রস্থ পথ ধরে এগিয়ে যাবেন শাহীন শাহ আফ্রিদি। 

কথায় কথায় একটা ব্যাপার প্রচলিত হয়ে গিয়েছে, মেলবোর্ন হারিস রউফের নিজের মাঠ। জাতীয় দলে খেলার আগেও মেলবোর্নে নিজের ঘাঁটি বানিয়েছিলেন হারিস রউফ। মেলবোর্নের সবুজ প্রান্তর জুড়ে জড়িয়ে আছে তাঁর সুখস্মৃতি। তাই মেলবোর্নে নিজের ঝলকানিটা আরেকবার দেখাতে চাইবেন রউফ নিজেও। আর মঞ্চটার নাম ফাইনাল। তাই দূর পথের আরাধ্য স্বপ্ন ছোঁয়ার অভিপ্রায় তাঁর মাঝে নিশ্চিতভাবেই আছে। 

পাকিস্তানের একাদশে আরেকজনের কথা না বললেই নয়। শাদাব খান। এবারের আসরে রীতিমত উড়ছেন। ব্যাটিং, বোলিং কিংবা ফিল্ডিং-সব খানেই নিজের দ্যুতি ছড়াচ্ছেন। সমাপ্তিটাও তাই রঙিন করে রাখতে চাইবেন তিনি। আর সে যাত্রায় বাঁধাটা শুধু ইংল্যান্ড। সেটা টপকালে চ্যাম্পিয়ন তো পাকিস্তান হবেই। সাথে টুর্নামেন্ট সেরা ক্রিকেটারের খেতাবও পেতে পারেন শাদাব খান। 

পাকিস্তানের বোলিং, ইংল্যান্ডের ব্যাটিং – আপাতত এ দুই দলের সবচেয়ে শক্তিমত্তার জায়গা হল এটিই। তবে নির্দিষ্ট দিনে ব্যাটিং, বোলিং আর দারুণ ফিল্ডিংয়ের মিশ্রণ ঘটলেই তো একটা দল জেতে। মেলবোর্নের ফাইনালেও নিশ্চয় তেমন একটা কিছুরই দৃশ্যায়ন হবে। আর দুই দলই সমান গতিতে এগিয়ে গেলে ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের মতোও একটি ম্যাচের সাক্ষী হতে পারে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব। দিনশেষে স্নায়ুতে আলোড়িত করা সেই সব দৃশ্যের অনুরূপ রূপায়ন হলে মন্দ কী!

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link