কথায় সাত শূন্য! অঙ্কে সেটা ৭-০। সে যাই হোক না কেন, এমন স্কোরলাইনেই শেষ হয়েছে স্পেন-কোস্টারিকার এক পেশে ম্যাচটি। নব্বই মিনিটের খেলায় কোস্টারিকার জালে স্পেন বল পাঠিয়েছে গুণে গুণে সাতটি। প্রথমার্ধে তিনটি আর দ্বিতীয়ার্ধে চারটি। ম্যাচে সময়ের কাঁটা গড়িয়েছে, আর গোলের পরে গোল উৎসবে মাঠের মধ্যেই অনেকটা জয়োৎসবে মেতে উঠেছিল স্প্যানিশরা।
১৯৯৮ বিশ্বকাপে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ৬-১ গোলে জয় পেয়েছিল স্পেন। আর সেটিই এতদিন পর্যন্ত বিশ্বকাপে স্পেনের পাওয়া সবচেয়ে বড় জয় ছিল। দুই যুগ পরে এসে, ৭-০ গোলের জয়ে এবার সে রেকর্ডটিকে ছাপিয়ে গেল লুই এনরিকের দল।
ফুটবল মানচিত্রে স্পেনের আগ্রাসনের শুরু এই শতাব্দীতেই। ২০০৮ এর ইউরো দিয়ে শুরু, এরপর ২০১০-এ এসে বিশ্বকাপ জয়। তার ঠিক দুই বছর পর আবারও ইউরো জয়। ভিসেন্তে দেল বস্কের অধীনে দলটা রীতিমত অপরাজেয় হয়ে উঠেছিল সে সময়।
এরপরে সেই ধারাবাহিকতায় কিছুটা ছেদ পড়লেও স্পেন ঠিক আগের মতই আবারও অবিরাম গতিতে পথচলা শুরু করেছে। দলে তেমন বড় তারকা নেই, কিন্তু আছে তারুণ্যের মিশেলে দারুণ কিছু ফুটবলার। টিমম্যান বলতে যেমন বোঝায় সেই রসদটাতেই পূর্ণ এই স্পেন দল।
তবে স্পেনের এই অগ্রযাত্রায় সব সময়ই বিচরণ করেছে টিকিটাকার ফুটবল। সেটাকে টোটাল ফুটবল বললেও ভুল হয় না। মাঠের বল দখলের লড়াইয়ে দারুণ এক কৌশল এই টিকিটাকা। মাঝমাঠের দারুণ নিয়ন্ত্রণ রেখে ছোট ছোট পাস এবং মুভমেন্টের এই শৈল্পিক কৌশলের মাধ্যেমে প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগকে সুকৌশলে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অনবদ্য এক কৌশল এই টিকিটাকা।
কোস্টারিকার বিপক্ষে স্পেন আজ সেটিই করেছে। শুরু থেকেই মাঝ মাঠে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। সফল পাস দেওয়ার দিক দিয়ে বিশ্বকাপ ফুটবল ইতিহাসে একটি নতুন রেকর্ডও গড়েছে তারা। আজকের ম্যাচে তাদের সফল পাস সংখ্যা ছিল ৯৭৬। এর আগে যা এত সংখ্যক সফল পাস দেওয়ার কীর্তি আর কোনো দলের ছিল না।
টিকিটাকার এই কৌশলটা সর্বপ্রথম আসে ডাচ কিংবদন্তি ফুটবলার ইয়োহান ক্রুইফের হাত ধরে। ১৯৮৮ সালে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি এ ধারণার প্রবর্তন করেছিলেন। তবে স্পেন ফুটবলে সেই কৌশলের পূর্ণতা পেয়েছিল ভিসেন্তে দেল বস্কের হাত ধরে। মূলত সেখান থাকেই টিকিটাকা ফুটবলের সাথে চিরায়ত ট্যাগটা লেগে যায় স্পেনের পাশে।
টিকিটাকার এ শৈল্পিক কৌশল বার্সা এখনও ধারণ করে। আর সেই বার্সার সিংহভাগ ফুটবলারই এবারের বিশ্বকাপে স্পেনের হয়ে খেলছে। তাছাড়া স্পেনের কোচ লুই এনরিকেও এক সময় বার্সার কোচ ছিলেন। পাশাপাশি এনরিকে একজন লামআসিয়া গ্রাজুয়েটও। যেখানটাকে বলা যেতে পারে, টিকিটাকা ফুটবলের আঁতুড়ঘর।
স্বভাবতই এনরিকের কৌশলেও সেই ছাপ থাকবে। স্পেনের কোচ হওয়ার পর থেকে ঠিক সেদিকেই নজর দিয়েছেন তিনি। প্রতিবারই দল নির্বাচনের পরে তাঁকে নিয়ে সমালোচনা ধেয়ে এসেছে। কিন্তু সেগুলোর কোনো তোয়াক্কাই করেননি তিনি। নিজের ট্যাক্টিসে যথার্থ হবে, এমন ফুটবলারকেই দলে ঢুকিয়েছেন সব সময়।
মূলত মধ্যমাঠে পাসিং সক্ষমতা যাদের বেশি তাদেরকেই দলে নেওয়ার ক্ষেত্রে দিয়েছেন বেশি গুরুত্ব। এনরিকের সেই ট্যাক্টিসে তিনি সফলও হয়েছেন। মাঝ মাঠে ভরসা রেখেছেন পেদ্রি, বুস্কেটস আর গাভিকে। যে তিনজনই ছোট ছোট পাস আর মুভমেন্ট দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঠান্ডা মাথায় ভড়কে দিতে পারে। হয়েছেও সেটি, বুস্কেটস থেকে শুরু করে গাভি, পেদ্রি দুজনেই কোস্টারিকার বিপক্ষে খেলেছেন দুর্দান্ত। গাভি নিজে একটি গোলও করেছেন।
মূলত তারুণ্য নির্ভর দল হলেও, স্পেন বেশ গোছানো একটা দল। তাদের চিরায়ত টেকনিকে তারা নিজেদের দিনে যে কোনো দলকেই হারিয়ে দিতে পারে। সেই সক্ষমতা এই দলটার আছে। এমনকি কোচ হিসেবেও সফল হওয়ার দিক দিয়ে দারুণ সমৃদ্ধ এনরিক।
বিশ্বকাপের শুরুর ম্যাচেই ৭ গোল। একদম উড়ন্ত শুরু যাকে বলে, সেটাই হল স্পেনের কাতার বিশ্বকাপ যাত্রায়। ইউরোতে স্পেনের দৌড় সেমিতে আটকে গিয়েছিল। সেটিকে ছাপিয়ে এখন কাতার বিশ্বকাপে ঐ দূর পথের স্বপ্ন দেখতেই পারে এনরিকের দল। কারণ তারুণ্য আর অভিজ্ঞতার মিশেলে শীর্ষে যাওয়ার পথে সব ধরনের রসদ আছে এই দলে। তবে আপাতত এখন গ্রুপ ই এর চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরবর্তী রাউন্ড নিশ্চিত করার দিকেই চোখ থাকবে এনরিকের।
স্পেনের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ জার্মানির বিপক্ষে। জাপানের বিপক্ষে ম্যাচ হেরে যাওয়ায় এখন স্পেনের বিপক্ষে ম্যাচটি এক প্রকার বাঁচা মরার লড়াই হয়ে গিয়েছে জার্মানদের জন্য। লড়াইটা জার্মানির জন্য তাই একটু কঠিনই। একই কথা স্পেনের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ জার্মানি জাপানের কাছে হেরে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গেলেও তারা এই বিশ্বকাপের এখন পর্যন্ত অন্যতম একটা হট ফেবারিট দল হয়েই আছে।
তাই কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচের মত এ ম্যাচটা অতটা সহজ হবে না বুস্কেটস আলবাদের জন্য। কিন্তু দলটার নাম স্পেন। টিকিটাকার ফুটবল যাদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, সেই মরনাস্ত্র কৌশলেই আরেকবার স্পেনের অনন্য এ ধরনে সৌন্দর্যমন্ডিত হতেই পারে এ ফুটবল ধরণী।