রাস্তায় ও বাড়ির বারান্দায় টাঙানো পতাকায়, কিংবা জন মানুষের পোশকে- ফুটবল বিশ্বকাপ আসলেই যেন চারিদিক ফুটবলের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। সাধারণত ব্রাজিল সেরা, না আর্জেন্টিনা- এই তর্কই চায়ের কাঁপে ঝড় তোলে।
বিশ্বব্যাপী ফুটবল জোয়ারে সরব হয়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষও। এমন নয় যে দেশ হিসেবে আমরা ফুটবলে তেমন নাম করতে পেরেছি। কিন্তু স্রেফ ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা আমাদের বাধ্য করে বিশ্বকাপের উৎসাহে শামিল হতে। এদেশে ব্রাজিল সমর্থকদের যেমনি অভাব নেই, তেমনি আর্জেন্টাইন সমর্থকদের সংখ্যাও অগণিত।
এই যে, গতকাল বিশ্বকাপের আসরে আর্জেন্টিনার প্রথম জয়লাভের কথাই ধরুন না। বাংলাদেশি আর্জেন্টাইন সমর্থকরা একটি করে গোল হওয়ায় দূর দূরান্ত থেকে মানুষের চিৎকার ভেসে আসছিল। ম্যাচ শেষে হাজার হাজার সমর্থক নিজেদের মত করে আনন্দ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে গিয়েছিল।
এমন নয় যে, আর্জেন্টিনার সাথে বাঙালি আর্জেন্টাইন ভক্তদের কোন সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। কতটা নিখুঁত ভালোবাসা থাকলে একটা দেশের একটা গোটা সমর্থক গোষ্ঠী একটা ভিনদেশকে এতটা আপন করে নিতে পারে ভাবুন তো!
আর্জেন্টিনার প্রতি, মেসির প্রতি বাংলাদেশি আর্জেন্টাইন ভক্তদের এমন নিখাদ ভালোবাসা সাড়া ফেলে দিয়েছে খোদ আর্জেন্টিনার সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও। আর্জেন্টিনা থেকে প্রায় সতেরো হাজার কিলোমিটার দূরের একটি দেশ, তাঁদের সাথে তাল মিলিয়ে জয় উদযাপন করছে- অভিভূত করার মত ব্যাপারই বটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনাসহ এদেশের নানা জায়গাতে হাজার ধর্মের, শ্রেণীর মানুষ একজোট হয়েছে কেবল আর্জেন্টিনা বনাম মেক্সিকো ম্যাচটিতে শামিল হওয়ার তরে। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম যেমন টিওয়াইসি স্পোর্টস কিংবা ইনফেবে-সহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশি আর্জেন্টাইন সমর্থকদের এমন ভালোবাসার খবর প্রকাশিত হয়েছে।
উঁচু উঁচু ভবনে বিশাল হালকা নীল-সাদা পতাকা টাঙ্গানো কিংবা একজন রিকশা চালকের স্বল্প আয়ে কেনা ছোট্ট একটি আর্জেন্টিনার পতাকা রিকশার সামনে রাখা, অথবা একটি টিভি চ্যানেলের সঞ্চালক আর্জেন্টিনার জার্সি পরেই খবর পড়তে আসা- এসবকিছু প্রমাণ করে আর্জেন্টিনা কতটা গুরুত্ববহ এই জাতির জন্য।
আলবিসেলেস্তাদের হারে এই দেশের মানুষ মন:ক্ষুণ্ণ হয়, আবার তাঁদেরই জয়ে এদেশীয় ভক্তরা বছরের অন্যতম সুখের ঘটনার সাক্ষী পায়। এই দেশের একটি বিশাল অংশের মানুষের জন্য আর্জেন্টিনা হলো একটি আবেগের নাম। যে আবেগকে তাঁরা নিহস্বার্থে আজীবন লালন করে যায়।
আর্জেন্টিনা জিতলে তাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুশির বার্তা দেয়, আর হারলে আশার। এমনকি ‘আর্জেন্টিনা ফুটবল ফ্যানস বাংলাদেশ’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপও রয়েছে যার প্রায় তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সদস্য রয়েছে। যেটি আর্জেন্টিনা দলের সমস্ত কার্যকলাপ অনুসরণ করে এবং দলটির জন্য নিজেদের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দেয়। কেবল তাই নয় ধর্মপ্রাণ এই দেশের মানুষের প্রার্থনায়ও দলটি থাকে।
সেই ডিয়েগো ম্যারাডোনা থেকে আজকের মেসি- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ভালোবাসাটা কমে না, বরং বাড়ে। এদেশ একজন ম্যারাডোনার কল্যাণে আর্জেন্টিনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিল। এমনকি ২৫ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে ম্যারাডোনা যখন মারা যায় এদেশের সর্বস্তরের মানুষের মাঝে শোক নেমে আসে। এমনকি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলও তখন এক মিনিট নীরবতা পালন করেছিল। তারপর তো ফুটবলের রাজপুত্র মেসির যুগ।
ম্যারাডোনা ছিলেন এই দেশের ভক্তদের কাছে সুপারস্টারের মত। চুলের স্টাইল, এই সুপারস্টারের জুতার আদলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পুমা কিং বুট, কিংবা কিশোরদের ফুটবলার হতে অনুপ্রেরণা এদেশের সব কিছুতেই ম্যারাডোনা ছিলেন।
এদেশের মানুষ নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছিল ম্যারাডোনাকে, ভালোবাসছে মেসিকে, এবং ভালোবেসে যাবে আর্জেন্টিনাকে। যেভাবে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল এদেশের সমর্থকদের হৃদয়ে ভালোবাসার জায়গা করে নিয়েছিল, তেমনি আজ এদেশী আর্জেন্টাইন ভক্তরাও আর্জেন্টিনার জন মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন। ফুটবলবিশ্বের বেশ সুন্দর ঘটনাই বটে!