স্পেনের সর্বকালের সেরা একাদশ

ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল স্পেন। বিশেষ করে ২০০৮ থেকে ২০১২ এই চার বছর গোটা বিশ্বে রাজত্ব করেছে লা রোজারা। একমাত্র দল হিসেবে টানা তিনটি মেজর ট্রফি(ইউরো-বিশ্বকাপ-ইউরো) জেতার কৃতিত্ব তাঁদের দখলে। অসাধারণ সব ফুটবলাররা খেলে গিয়েছেন স্পেনের জার্সিতে। আসুন দেখে নেয়া যাক, স্পেন জাতীয় দলে খেলা ফুটবলারদের নিয়ে গঠিত নির্বাচিত সেরা একাদশ। 

  • ইকার ক্যাসিয়াস (গোলরক্ষক)

স্পেনের সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে ইকার ক্যাসিয়াসের জায়গা পাওয়াটা প্রশ্নাতীত। দুর্দান্ত শট স্টপিং দক্ষতা এবং দারুণ রিফ্লেক্সের জন্য খ্যাতি ছিল রিয়াল মাদ্রিদ এবং স্পেনের সাবেক এই কিপারের। ইকার ক্যাসিয়াস সেই অল্প  ফুটবলারদের একজন যারা কিনা এক হাজারের বেশি ম্যাচ খেলেছেন।

রিয়াল মাদ্রিদের যুব দল দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা ক্যাসিয়াস পুরো ক্যারিয়ারটা কাটিয়েছেন লস ব্ল্যাংকোসদের জার্সিতে। টানা ১৬ বছর আস্থার সাথে সামলেছেন মাদ্রিদের গোলবার। ক্লাব এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সকল ট্রফিই জিতেছেন এই গোলকিপার। স্পেনের হয়ে সর্বোচ্চ ১৬৭ আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নামার কৃতিত্বও এই গোলরক্ষকের দখলে।  

  • ফার্নান্দো হিয়েরো (সেন্টারব্যাক)

ইকার ক্যাসিয়াসের সামনে সেন্টার ডিফেন্ডার হিসেবে থাকবেন তারই সতীর্থ ফার্নান্দো রুইজ হিয়েরো। নিজের সময়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ছিলেন হিয়েরো। 

১৯৮০ সালে মালাগার বয়সভিত্তিক দলের মাধ্যমে ফুটবল ক্যারিয়ারের সূচনা ঘটে হিয়েরোর। এরপর রিয়াল ভালাদোলিদ হয়ে ১৯৮৯ সালে যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে। এরপর থেকেই মাদ্রিদ আর হিয়েরো হয়ে যান একে অন্যের পরিপূরক।

১৪ বছরের মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে পাঁচবার লা লিগা জেতার পাশাপাশি তিনবার জেতেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। স্পেনের হয়ে চারটি বিশ্বকাপ এবং দুইটি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপ খেলার পাশাপাশি তাঁর আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা ৯০টি। লম্বা এবং শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় সেন্ট্রাল ডিফেন্সে হিয়েরোকে পরাস্ত করা ছিল ভীষণ দুঃসাধ্য। 

  • কার্লোস পুয়োল (সেন্টারব্যাক)

স্পেনের সর্বকালের সেরা একাদশে সেন্টারব্যাক হিসেবে ফার্নান্দো হিয়েরোর সাথে জুটি বাধবেন কার্লোস পুয়োল। হিয়েরো রিয়াল মাদ্রিদে খেললেও পুয়োল তাঁর ক্যারিয়ারের পুরো সময়টা কাটিয়েছেন বার্সেলোনায়। 

১৫ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারে জিতেছেন সম্ভাব্য সকল ট্রফিই, পাঁচবার লা লিগার পাশাপাশি তিনবার জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা। এছাড়া দুবার জিতেছেন ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা। লা রোজাদের হয়ে অভিষেক ২০০০ সালে। ২০০৮ ইউরো এবং ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী স্পেনের রক্ষণভাগের মূল স্তম্ভ ছিলেন পুয়োল। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে জয়সূচক গোলটা এসেছিল তাঁর হেডের মাধ্যমেই। 

  • হোসে আন্তোনিও কামাচো (লেফটব্যাক)

এই একাদশে রক্ষণের বাঁ প্রান্তটা সামলানোর দায়িত্ব থাকবে জোসে আন্তোনিও কামাচোর কাঁধে। ১৯৭২ সালে আলবেসেন্তের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও সবাই তাকে চেনেন রিয়ালের কামাচো হিসেবেই। 

বয়স ২০ পেরোনোর আগেই জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে কামাচর। জাতীয় দলের জার্সিতে ৮০টি ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ১৩ বছরের ক্যারিয়ারে দুটি করে বিশ্বকাপ এবং ইউরোতে মাঠে নামেন এই লেফটব্যাক। ১৯৮৮ সালে ৩৩ বছর বয়সে সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর নেন তিনি। এরপর জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বে ছিলেন চার বছর। 

  • সার্জিও রামোস (রাইটব্যাক)

সার্জিও রামোসের পরিচিতিটা মূলত সেন্টারব্যাক হিসেবে হলেও ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল রাইটব্যাক হিসেবে। এমনকি ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী দলটাতে রামোস খেলেছেন রাইটব্যাক হিসেবেই। ফলে স্পেনের সর্বকালের সেরা একাদশে রামোসকে রাখা হয়েছে রাইটব্যাক পজিশনে। 

৩৫ বছর বয়সী রামোস রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি গোল করতেও দারুণ পটু। নিজের সময়ের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয় রামোসকে। তাছাড়া বলের উপর দারুণ নিয়ন্ত্রণ থাকায় রামোস সব সময়ই প্রতিপক্ষের জন্য বিপদজ্জনক সব পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। 

  • জাভি হার্নান্দেজ (ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার)

বর্তমান বার্সেলোনা কোচ জাভি হার্নান্দেজ থাকবেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় বার্সেলোনায় কাটানোর পাশাপাশি দলটার হয়ে লা লিগা জিতেছেন আটবার। এছাড়া চার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। দুই সতীর্থ আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা এবং সার্জিও বুসকেটসকে সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ফুটবল ইতিহাসের সেরা মিডফিল্ড ট্রায়ো। 

বার্সেলোনার হয়ে সর্বোচ্চ ৭৬৭ ম্যাচে মাঠে নামার রেকর্ড তাঁর দখলেই। মাত্র ১১ বছর বয়সে বার্সার একাডেমি লা মাসিয়াতে যোগ দেন জাভি। বয়সভিত্তিক দলগুলো পেরিয়ে ১৯৯৭ সালে মূল দলে জায়গা করে নেন এই মিডফিল্ডার। এরপরের টানা ১৫ মৌসুম খেলে গিয়েছেন ব্লুগ্রানাদের হয়ে। 

ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হলেও গোল করা কিংবা করানো দুই ভূমিকাতেই দারুণ সফল জাভি। ২০১৫ সালে কাতারের ক্লাব আল সাদে যোগ দেন তিনি, তাঁদের হয়ে টানা চার লিগ জেতার পর সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দেন জাভি। 

  • আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা (সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার)

সাবেক বার্সেলোনা এবং স্পেন মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় খেলছেন জাপানি ক্লাব ভিসেল কোবেতে। বার্সেলোনা তো বটেই স্পেনের ইতিহাসের সেরা মিডফিল্ডার ভাবা হয় তাঁকে।

এমনকি ফুটবল ইতিহাসের সেরা ফুটবলারদের ছোট্ট তালিকায়ও ইনিয়েস্তা ঢুকে যাবেন অনায়াসেই। ১৬ বছরের বার্সা ক্যারিয়ারে ৭৬৪ ম্যাচে মাঠে নামার পাশাপাশি ৩৫টি ট্রফি জিতেছেন। মিডফিল্ডার হলেও ৫৭ গোল করার পাশাপাশি ১৩৯ গোলে অ্যাসিস্ট রয়েছে তাঁর। 

২০০৯ এবং ২০১৫ ট্রেবলজয়ী বার্সা দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন ইনিয়েস্তা। স্পেনের হয়ে ১৩১ ম্যাচে মাঠে নেমে ১৩ গোল করেন এই মিডফিল্ডার। ২০১৮ সালে জাতীয় দল থেকে অবসর নেন ইনিয়েস্তা। 

  • লুইস সুয়ারেজ মিরামন্তেজ (আক্রমণাত্নক মিডফিল্ডার)

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে স্পেনের সেরা ফুটবলার ছিলেন লুইস সুয়ারেজ। আক্রমণাত্নক মিডফিল্ডার হিসেবে খেললেও মাঠের ডানপ্রান্ত দিয়ে আক্রমণ শানাতে বেশি পছন্দ করতেন তিনি। খেলেছেন দেপোর্তিভো লা করুণা, এস্পানিওল, বার্সেলোনা, ইন্টার মিলান, সাম্পদোরিয়ার মত দলে। স্পেনের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার ভাবা হয় তাঁকে। 

ফ্যাব্রিল নামের নিচের লিগের এক ক্লাব দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও লুইস সুয়ারেজকে খ্যাতি এনে দেয় বার্সেলোনা। তাঁদের হয়ে ছয় মৌসুমে ৬৫ ম্যাচে করেন ৩০ গোল। দুইবার করে লা লিগা এবং কোপা দেল রে জেতান দলকে। ১৯৬১ সালে বার্সা ছেড়ে ইতালিতে পাড়ি জমান এই তারকা। ১৯৭৩ সালে সব ধরনের ফুটবল থেকে অবসর নেন সুয়ারেজ।

  • পাকো গেন্তো (লেফট উইঙ্গার)

ফ্রান্সিস্কো গেন্তো লোপেজকে মূলত পাকো গেন্তো নামেই চেনেন ফুটবল প্রেমীরা। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন রিয়ালের ডেরায়, মাঝে কেবল এক মৌসুম খেলেছেন রেসিংয়ের হয়ে। 

রিয়ালের ১১ নম্বর জার্সিটাকে রীতিমত আইকনিক করে তোলেন গেন্তো। মাদ্রিদের ক্লাবটিকে ইউরোপিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতান ছয়বার। ইউরোপিয়ান ক্লাব ফাইনালে সবচেয়ে বেশিবার মাঠে নামার রেকর্ডও তাঁর দখলে। 

দুর্দান্ত গতি আর ভিশনের পাশাপাশি দারুণ ফিনিশিং করার দক্ষতা ছিল গেন্তোর। রেমন্ড কোপা, ডি স্টেফানো, পুসকাসদের নিয়ে অবিশ্বাস্য এক আক্রমণভাগ করে তুলেছিলেন গেন্তো।

  • ডেভিড ভিয়া (রাইট উইঙ্গার)

নিজের সময়ের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বিবেচনা করা হয় ডেভিড ভিয়াকে। স্ট্রাইকার হলেও বক্সে বলের অপেক্ষায় না থেকে বরং নিচে নেমে আক্রমণ গড়ে তুলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।

স্পেনের হয়ে ২০০৫ সালে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে তাঁর। ২০০৮ ইউরো এবং ২০১০ বিশ্বকাপ জয়ী স্পেন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন ভিয়া। জাতীয় দলের হয়ে বরাবরই পারফর্ম করে গিয়েছেন। ২০০৬ বিশ্বকাপে তিন গোল, ২০০৮ ইউরোর সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার পাশাপাশি ২০১০ বিশ্বকাপে জেতেন সিলভার বুট। জাতীয় দলের জার্সিতে ৯৮ ম্যাচে ৫৯ গোল করেন ভিয়া। ২০১৪ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি।

  • রাউল (স্ট্রাইকার)

স্পেনের সর্বকালের সেরা একাদশে স্ট্রাইকার হিসেবে থাকবেন রিয়াল মাদ্রিদের ঘরের ছেলে রাউল। প্রায় ১৬ বছরের ক্লাব ক্যারিয়ারে ৩২৩ গোলের পরিসংখ্যানই জানান দেন গোলমুখে কতটা ভয়ংকর রাউল। লা লিগার ইতিহাসে পঞ্চম সর্বোচ্চ গোলস্কোরার তিনি। 

২০০১ সালে ব্যালন ডি’অর জেতার খুব কাছে ছিলেন রাউল, যদিও শেষপর্যন্ত জিততে পারেননি। সেবার খুব অল্প ব্যবধানে ব্যাল জিতে নেন মাইকেল ওয়েন। মাদ্রিদের বয়সভিত্তিক দলগুলো পেরিয়ে ১৯৯৪ মৌসুমে প্রথম বারের মত সুযোগ পান মূল দলে। এছাড়া রাউলের নেতৃত্বগুণও অসাধারণ, পুরো দলকে এক সুতোয় গাথার ক্ষমতা ছিল তাঁর মাঝে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link