স্টিভ টিকোলো: কেনিয়ান ক্রিকেটের পোস্টার বয়

‘ছোট দলের বড় তারকা’ প্রসঙ্গটি উঠলেই সবার আগে যার নাম মাথায় আসে তিনি হলেন স্টিভ টিকোলো। দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ, সবচেয়ে বেশি রান ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক টিকোলোকে বলা হয় কেনিয়ান ক্রিকেটের প্রবাদপুরুষ।

টিকোলোর হাত ধরেই ক্রিকেট মানচিত্রে একটা শক্ত অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল কেনিয়া। ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফির ফাইনালে উঠে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন, প্রথম বিশ্বকাপেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে অঘটনের জন্ম দেয়া, ২০০৩ বিশ্বকাপের শেষ চারে জায়গা করে নেয়া — কেনিয়ান ক্রিকেটের প্রতিটি অর্জনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে স্টিভ টিকোলোর নাম।

কেনিয়ার সাবেক অধিনায়ক জিমি কামান্ডের ভাষায়, ‘এই মানুষটির কাছে কেনিয়ান ক্রিকেট চিরঝণী। কেনিয়ার ক্রিকেটে যা কিছু অর্জন, সব সম্ভব হয়েছে টিকোলোর জন্য।’

সে যুগের অনেকের মতে, ফর্মের তুঙ্গে থাকা টিকোলো নাকি এতটাই দুর্দান্ত খেলোয়াড় ছিলেন যে বিশ্বের যেকোন দলের হয়ে খেলার যোগ্যতা রাখতেন! তাঁকে ভারতীয় ‘মাস্টার ব্লাস্টার’ শচীন টেন্ডুলকারের সাথেও তুলনা করতেন কেউ কেউ। এর পেছনে অবশ্য যথেষ্ট কারণ ছিল; সহযোগী দেশগুলোতে যে টিকোলো মানের ব্যাটসম্যান আর একজনও ছিল না, এমনকি বাংলাদেশেও না!

ক্রিকইনফোর বিশিষ্ট কলাম লেখক মার্টিন উইলিয়ামসনের ভাষায়, ‘In his full flow, he can be a punishing player at any level. It is a measure of his ability and standing that Steve Tikolo has epitomised Kenyan cricket.’

১৯৭১ সালের ২৫ জুন, কেনিয়ার নাইরোবির একটি স্বনামধন্য ক্রিকেট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন টিকোলো। পুরো নাম স্টিফেন ওগোনজি টিকোলো, সতীর্থদের কাছে পরিচিত ছিলেন গানজি (যিনি বন্দুক চালনায় পারদর্শী) নামে। বড় দুই ভাই টম ও ডেভিড আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন কেনিয়ার হয়ে, স্টিভও হেঁটেছেন তাঁদের দেখানো পথেই। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে তো তিন ভাই-ই খেলেছেন একসঙ্গে!

কেনিয়ার ইতিহাসে অবিসংবাদিত সেরা ব্যাটসম্যান টিকোলো ছিলেন মিডল অর্ডারে দলের প্রধান ভরসা। ক্যারিয়ার জুড়ে অনেক নামীদামী বোলারকে সামলেছেন শক্ত হাতে। বোলার যেই হোক, বাজে বলকে যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে কখনও কার্পণ্য করতেন না।

স্পিনের বিপক্ষে ফুটওয়ার্ক এবং পেসের বিপক্ষে আই রিফ্লেক্স নির্ভর ব্যাটসম্যান ছিলেন টিকোলো। যখন ছন্দে থাকতেন, তাঁকে ব্যাটিং করতে দেখাটা ছিল চোখের জন্য প্রশান্তি। ফ্লিক, কাভার ড্রাইভ, সুইপ, ইনসাইড আউটসহ প্রায় সব ধরনের ক্রিকেটীয় শট ছিল টিকোলোর হাতে। তাঁর ব্যাটিংয়ে একটা ‘ক্যারিবিয়ান ফ্লেভার’ পাওয়া যেত বলেও মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ। আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছি, তাঁরা খুবই সৌভাগ্যবান যে চোখের সামনে এই মানুষটার খেলা দেখতে পেয়েছি।

স্টিভ টিকোলোর বোলিং স্টাইল ছিল ডানহাতি স্লো মিডিয়াম। ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসে অবশ্য ক্রিস গেইলের মত জেন্টল অফ স্পিনার হয়ে যান। ওয়ানডেতে ৩২ গড়ে ৯৪ উইকেট আর ৪.৭৩ ইকোনোমি রেটই বলে দেয় যে বল হাতেও তিনি ছিলেন ‘মোর দ্যান ইউজফুল’।

১৯৯৬ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টিকোলোর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলার শুরু। অভিষেকেই নিজের প্রতিভা ও ব্যাটিং দক্ষতা দিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সবাইকে। তিন নম্বরে নেমে উপহার দিয়েছিলেন ৮৩ বলে ৬৫ রানের মনোমুগ্ধকর এক ইনিংস। যেখানে দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের কেউ ত্রিশের কোটাই পার হতে পারে নি!

সেই ১৯৯৬ বিশ্বকাপেই ইতিহাসের অন্যতম বড় অঘটন দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। ভারতের পুনেতে এক লো-স্কোরিং ম্যাচে ‘পুঁচকে’ কেনিয়া হারিয়ে দিয়েছিল দুইবারের ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন’ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে! কেনিয়ার ১৬৬ রানের জবাবে অলআউট হবার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা করতে পেরেছিল মাত্র ৯৩ রান! কেনিয়ার ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ছিল ২৯ রান। ব্যাটসম্যানের নামটা আন্দাজ করতে পারছেন বোধ হয়, স্টিভ টিকোলো! এমনকি দু’দল মিলিয়ে ম্যাচের একমাত্র ছক্কাটাও টিকোলোই মেরেছিলেন!

তবে ২৯ কিংবা ৬৫ নয়, নিজের বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটা তিনি খেলেছিলেন ক্যান্ডিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ৯৫ বলে ৯৬ রানের চোখ ধাঁধানো সেই ইনিংসটি সাজানো ছিল ৯ বাউন্ডারি ও ৪ ছক্কায়!

এবারে আসি ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি প্রসঙ্গে। ফাইনালে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৪১ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর দাঁড় করিয়েছিল কেনিয়া। ২৪১ রানের মধ্যে টিকোলো একাই করেছিলেন ১৪৭! এক ডজন বাউন্ডারির সাথে ছক্কা মেরেছিলেন ৫টা! মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত বৃষ্টিবিঘ্নিত ফাইনালে শেষ পর্যন্ত জিতেছিল বাংলাদেশই; তবে টিকোলোর ১৪৭ রানের অনবদ্য ইনিংসটি জিতেছিল মন!

উল্লেখ্য, সেবার রানার্সআপ হয়েও ১৯৯৯ বিশ্বকাপের মূল পর্বে জায়গা করে নেয় কেনিয়া; প্রথমবারের মত অর্জন করে ওয়ানডে স্ট্যাটাস। যার অন্যতম নেপথ্য কারিগর ছিলেন স্টিভ টিকোলো। মরিস ওদুম্বের (৫১৭) পর টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩৯২ রান এসেছিল টিকোলোর ব্যাট থেকে।

১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ এবং কেনিয়াকে নিয়ে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ আয়োজন করেছিল ভারত। সেই টুর্নামেন্টেই ভারতকে হারিয়ে আরও একটি বড় অঘটনের জন্ম দেয় কেনিয়া।

ব্যাঙ্গালোরে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচটা ভারত অনায়াসে জিতলেও ৯২ বলে ৭৭ রানের একটি দর্শনীয় ইনিংস উপহার দেন স্টিভ টিকোলো। চেন্নাইতে পরের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়সূচক ৬৫ রান ও ২ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরষ্কার। তারপর গোয়ালিয়রে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচে ভারতকে ৬৯ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে ইতিহাস গড়ে কেনিয়া। ব্যাট হাতে মাত্র ২১ রান করলেও বল হাতে তিন উইকেট নিয়ে ভারত বধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন স্টিভ টিকোলো। টানা দ্বিতীয়বারের মত হন ম্যাচ সেরা!

সেই ম্যাচে টিকোলোর বোলিং ফিগার ছিল ১০-০-২৯-৩। ভারতীয় ইনিংসের টপ স্কোরার রাহুল দ্রাবিড়ের (৩৩) মহামূল্যবান উইকেটটাও গিয়েছিল টিকোলোর ঝুলিতে।

১৯৯৯ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ, জিম্বাবুয়ে এবং কেনিয়াকে নিয়ে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির দেখা পান স্টিভ টিকোলো। তাঁর ১১১ বলে অপরাজিত ১০৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংসের সৌজন্যেই বাংলাদেশকে হেসে খেলে হারায় কেনিয়া।

সেঞ্চুরির আশা জাগিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরের ম্যাচেও। জিম্বাবুয়ের বেঁধে দেয়া ২৮১ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে টিকোলো-ওদুম্বে জুটির দৃঢ়তায় জবাবটা বেশ শক্ত হাতেই দিচ্ছিল কেনিয়া। কিন্তু ১৫০ রানের মাথায় টিকোলোর বিদায়ের পরই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে কেনিয়ান ইনিংস। টিকোলোর ব্যাট থেকে আসে ৮৭ বলে ৭৮ রানের স্ট্রোক ঝলমলে একটি ইনিংস।

ব্যাট হাতে পাওয়া ছন্দটা টিকোলো ধরে রেখেছিলেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও। ইংল্যান্ড ও ভারতের বিপক্ষে হাঁকিয়েছিলেন ‘ব্যাক টু ব্যাক’ হাফ সেঞ্চুরি। ক্যান্টারবারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৭১ রানের ইনিংস খেলার পর ব্রিস্টলে ভারতের বিপক্ষে করেন ৫৮ রান। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরাজিত দলের সদস্য হয়েও জিতে নেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

একই বছর নাইরোবিতে একটি ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ‘শক্তিশালী’ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আরেকটু হলেই অঘটন ঘটিয়ে ফেলছিল কেনিয়া! প্রোটিয়াদের দেয়া ২২১ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে একপর্যায়ে কেনিয়ার সংগ্রহ ছিল ৪ উইকেটে ১৫৬। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা অলআউট হয় ১৯৬ রানে! ৮৫ বলে সর্বোচ্চ ৬৭ রান এসেছিল টিকোলোর ব্যাট থেকে।

২০০১ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচ। সেদিন টিকোলোর ব্যাট যেন খাপ খোলা তলোয়ার। ৬ চার ও ৩ ছক্কায় করলেন ৫৭ বলে ৭১! কিন্তু এতকিছুর পরেও দলের হোয়াইটওয়াশ এড়াতে পারেন নি তিনি।

একই বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতকে দ্বিতীয়বার হারানোর আনন্দে ভাসে পূর্ব আফ্রিকার দেশটি। রবীন্দু শাহ, কেনেডি ওটিয়েনো আর থমাস ওডোয়োর ফিফটিতে কেনিয়া জিতেছিল ৭০ রানে। স্টিভ টিকোলোর ব্যাট থেকে এসেছিল ২৭ রান।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পরের ম্যাচে লড়াই করে হারলেও ৮৩ বলে অপরাজিত ৬৮ রানের সাহসী ইনিংস খেলে নিজের জাত চেনাতে একদমই ভুল করেন নি স্টিভ টিকোলো।

২০০২ সালে প্রথমবারের মতো কেনিয়ার অধিনায়ক মনোনীত হন স্টিভ টিকোলো। একই বছর শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং দক্ষিন আফ্রিকার কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় কেনিয়া। তবে দল হারলেও হারেন নি টিকোলো। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯১ বলে ৯৩ আর সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে করেন ৮৪ বলে ৬৯ রান।

কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি ধরা দেয় ২০০৩ বিশ্বকাপে। স্টিভ টিকোলোর সুযোগ্য নেতৃত্বে আসরের সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিল কেনিয়া। শেষ চারে ওঠার পথে তারা হারিয়েছিল বাংলাদেশ, শ্রীলংকা ও জিম্বাবুয়ের মত টেস্ট খেলুড়ে দলকে। সেমিতে ভারতের কাছে হেরে গেলেও কেনিয়ানরা বিদায় নিয়েছিল মাথা উঁচু করেই।

আগের দুই আসরের মত এবারেও ব্যাট হাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন টিকোলো। টুর্নামেন্ট সেরা অস্ট্রেলিয়ার শক্তিশালী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে ৫১ আর সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৫৬ রান। এছাড়া কানাডার বিপক্ষে খেলেন ৪২ রানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।

শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জেতা ম্যাচগুলোতে ব্যাটিংয়ে রান পেলেও টিকোলো জ্বলে উঠেছিলেন বল হাতে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩টি এবং জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পেয়েছিলেন ২টি করে উইকেট।

তবে সবচেয়ে স্মরণীয় উইকেট দুটো পেয়েছিলেন ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে। উইকেট দুটো যে ছিল টেন্ডুলকার আর লারার!

২০০৩ বিশ্বকাপটা হতে পারত কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট। এত বড় অর্জন, অথচ তার ফলাফল ছিল শূন্য। কেনিয়ার টেস্ট স্ট্যাটাসপ্রাপ্তির জোর দাবি ওঠা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বঞ্চিত হতে হয় তাঁদের।

২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাজে পারফরম্যান্সের দায়ে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান টিকোলো। দেশে ফিরে বোর্ড কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। টিকোলোর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন দেশটির সকল খেলোয়াড় ও সমর্থকরাও। শেষ পর্যন্ত টিকোলোদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পুরনো বোর্ড মেম্বারদের অপসারণ করে গঠন করা হয় নতুন কমিটি আর টিকোলোকে দেয়া হয় পুনর্মেয়াদে অধিনায়কের দায়িত্ব।

২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২-২ ব্যবধানে সিরিজ ড্র করে কেনিয়া। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে টিকোলোর ব্যাটে চড়েই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল দলটি। ব্যাট হাতে স্ট্রোকবহুল ৮৩ বলে ৯৮ রানের ইনিংস খেলার বল হাতে ২ উইকেট নিয়ে টিকোলো হয়েছিলেন ম্যাচসেরা।

একই বছর বাংলাদেশ সফরে এসে ৪-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয় কেনিয়া। তবে ফতুল্লায় দর্শকদের বেশ আনন্দ দিয়েছিল টিকোলোর ৮৭ বলে ৮১ রানের স্ট্রোকবহুল ইনিংসটি।

আগের তিন আসরের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ বিশ্বকাপেও কোয়ালিফাই করে কেনিয়া। তবে এক সময়ের সাড়া জাগানো কেনিয়া তখন শক্তির বিচারে অনেকটাই দুর্বল। কানাডার বিপক্ষে জিতলেও ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সাথে হেরে যায় বড় ব্যবধানে। কানাডার বিপক্ষে অপরাজিত ৭২ আর ইংলিশদের বিপক্ষে ৭৬ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে টিকোলো অবশ্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, বয়স বাড়লেও এখনো ফুরিয়ে যান নি তিনি!

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে ইতিহাসের প্রথম নন টেস্ট প্লেয়িং ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ২৫০০ রানের মাইলফলক অর্জন করেন স্টিভ টিকোলো।

২০০৭ বিশ্বকাপ পরবর্তী সময়ে ব্যাট হাতে কিছুটা রানখরা দেখা গেলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসও এসেছে টিকোলার ব্যাট থেকে। বিশেষ করে বারমুডার বিপক্ষে মাত্র ১ উইকেটে জেতা ‘নেইল-বাইটারে’ টিকোলোর অপরাজিত ৮৯* রানের ‘প্রাইসলেস’ ইনিংসটির কথা না বললেই নয়।

২০০৮ সালে নাইরোবিতে জিম্বাবুয়ে ও আয়ারল্যান্ডকে নিয়ে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে শেষবারের মত কোন টেস্ট খেলুড়ে দলকে হারায় কেনিয়া। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৯৯ বলে ১০২ রানের ‘ম্যাচ উইনিং’ নকটি আসে টিকোলোর ব্যাট থেকে।

আগের চার বিশ্বকাপে ৮ টি হাফ সেঞ্চুরি করা টিকোলো নিজের পঞ্চম ও শেষ বিশ্বকাপ খেলেন ২০১১ সালে। টানা পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলা বিরল ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিও একজন। তবে বয়সের ভারে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত টিকোলো নিজের শেষ বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচ খেলে করেছিলেন মাত্র ৪৪ রান!

কলকাতার ইডেন গার্ডেনে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপে নিজের শেষ ম্যাচটি খেলতে নামেন টিকোলো। ব্যক্তিগত ১০ রানের মাথায় ফিরে যান রেমন্ড প্রাইসের শিকার হয়ে। তবে টিকোলোর আউটকে ঘিরে জিম্বাবুয়ের খেলোয়াড়রা কোন রকম উদযাপনে মেতে ওঠে নি সেদিন; বরং সবাই মিলে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে টিকোলোর উদ্দেশ্যে নিবেদন করেছিল সম্মানসূচক ‘গার্ড অব অনার’। শুধু কি তাই? টিকোলো মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে পৌঁছানো অব্দি মুহুর্মুহু করতালির মাধ্যমে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল ইডেনের দর্শকবৃন্দ।

একজন নন-টেস্ট প্লেয়িং ক্রিকেটারের জন্য এ এক বিরল সম্মান। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কেনিয়ান তথা বিশ্ব ক্রিকেটকে সেবা দিয়ে যাওয়া ‘একজন টিকোলো’র জন্য সম্মানটা প্রাপ্য ছিল বৈকি।

মজার ব্যাপার হল, ২০১১ সালে অবসর নেয়ার দুই বছর পর বোর্ডের অনুরোধে হঠাৎ অবসর ভেঙে আবার ফিরে এসেছিলেন টিকোলো! কেনিয়ান ক্রিকেটের বৃহত্তর স্বার্থে তেতাল্লিশ বছর বয়সে অংশ নিয়েছিলেন আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি’র কোয়ালিফাইং রাউন্ডে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে শেষবারের মত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার আগে তিনি কেনিয়ার হয়ে খেলেন চারটি টি-টোয়েন্টি এবং একটি ওয়ানডে।

নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ একদিনের ম্যাচে টিকোলো নেমেছিলেন সাত নম্বরে, অপরাজিত ১৭ রানের ইনিংস খেলার পথে জয়সূচক বাউন্ডারিটাও আসে তাঁর ব্যাট থেকেই।

  • টিকোলোর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান

১৩৫ ওয়ানডেতে ২৯.০৫ গড়ে টিকোলো করেছেন ৩৪২৮ রান, স্ট্রাইক রেট ৭৬। হাঁকিয়েছেন ৩টি সেঞ্চুরি ও ২৪টি হাফ সেঞ্চুরি। সর্বোচ্চ ১১১ রান, বিপক্ষ বারমুডা।

এছাড়া বল হাতে নিয়েছেন ৯৪ উইকেট; সেরা বোলিং ৪১ রানে ৪ উইকেট, বিপক্ষ স্কটল্যান্ড।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি টিকোলো আলো ছড়িয়েছেন বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগ মাতিয়েছেন ব্যাটে-বলে। একসময় তো ঢাকা লীগে রানের ফোয়ারা ছোটাতেন মোহামেডানের ‘ঘরের ছেলে’ স্টিভ টিকোলো।

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে টিকোলো বেছে নিয়েছেন পেশাদার কোচিং ক্যারিয়ার। ২০১২ সালে পূর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডার ব্যাটিং উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এরপর ২০১৩ সালে পালন করেন উগান্ডা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচের দায়িত্ব। কেনিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সাথে তাঁর সম্পর্কের তিক্ততার জন্য কেনিয়ার ক্রিকেটে অবদান রাখতে চেয়েও পারেন নি। অবশ্য ২০১৪ সালে কিছুদিনের জন্য পেয়েছিলেন কেনিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব।

২০১৬ সালে আবারও ফিরে যান উগান্ডায়, দেশটির জাতীয় দলের হেড কোচ হয়ে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও সেখানেই ছিলেন। উগান্ডা আইসিসি ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগের ডিভিশন থ্রি থেকে ডিভিশন টুতে উন্নীত হয়েছে টিকোলোর অধীনেই৷ সম্প্রতি টিকোলো যোগ দিয়েছেন আফ্রিকার আরেক দশ তাঞ্জানিয়ার হেড কোচ হিসেবে।

পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই গড়ে প্রায় পাঁচ হাজার ফার্স্ট ক্লাস রানের মালিক টিকোলোর ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় আক্ষেপ বোধ হয় কখনও টেস্ট খেলতে না পারা। ২০০৩ বিশ্বকাপে টিকোলোর নেতৃত্বেই সেমিফাইনালে উঠেছিল কেনিয়া। এমন দারুণ অর্জনের পরেও টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া হয়নি কেনিয়ার, টিকোলোরও আর নামা হয় নি সাদা পোশাকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।

টেস্ট খেলেন নি তো কী হয়েছে? টেস্ট না খেলা দেশের ক্রিকেটারদের কাছে টিকোলো একটি অনুপ্রেরণার নাম। টেস্ট পরিবারের বাইরে থেকে উঠে এসেও যে বিশ্ব ক্রিকেটে এতটা প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব, সেটা সবার আগে টিকোলোই করে দেখিয়েছেন।

‘টিকোলো-বিহীন’ বর্তমান কেনিয়াকে নিয়ে আক্ষেপের অন্ত নেই ক্রিকেটানুরাগীদের। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, একটা সময় কী দারুণ দলটাই না ছিল কেনিয়া! সত্যিকারের ‘জায়ান্ট কিলার’! ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ খেলতে এসেই যারা হারিয়েছিল ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে! বিশ্বকাপের বাইরে যে দলটি ভারতের মত পরাশক্তিকে দিয়েছিল দু-দুবার হারের স্বাদ!

এককালে বাংলাদেশকে রীতিমতো বলে-কয়ে হারাত যারা! টেস্ট না খেলা প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের শেষ চারে পৌঁছানো সেই কেনিয়া আজ কোথায়? যে দলটিকে একসময় টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়ার জোর দাবি উঠেছিল ক্রিকেট দুনিয়ায়, আজ তাদের ওয়ানডে খেলার মর্যাদাটুকুও নেই! মরিস ওদুম্বে, স্টিভ টিকোলো, থমাস ওডোয়ো, কেনেডি ওটিয়েনো, রবিন্দু শাহ, মার্টিন সুজি, আসিফ করিম কিংবা হিতেশ মোদির মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া কেনিয়া এখন শুধুই সোনালী অতীত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link