ব্রাজিল সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম জিতেছে। এখন বাকি রয়ে গেল পর্তুগাল, হাঙ্গেরি আর নরওয়ে। তা শেষ দুজন তো এবার খেলছে না। তাহলে পর্তুগাল? যা চলছে, তাতে ফাইনালে প্রাক্তন উপনিবেশের সঙ্গে দেখা হতেই পারে পর্তুগালের। কিন্তু সে গল্প পরে। তার আগে কীরকম খেলল ব্রাজিল?
এই বিশ্বকাপের রক্ষণাত্মক কাঠামো বজায় রেখে মিড প্রেসে খেলতে পারা দলগুলির মধ্যে সবার উপরে থাকার কথা ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্ক, সার্বিয়া আর সুইজারল্যান্ড। তা শেষ দুটি দল এবছরের বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং-এ যথাক্রমে পর্তুগাল ও ইতালিকে পিছনে ফেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যোগ্যতা অর্জন করেছিল। সুইজারল্যান্ড তো গত ইউরোতে ফ্রান্সকেও হারিয়েছিল।
এদের খেলার ধাঁচ মোটামুটি এক। দুই উইং ব্যাক খুব দ্রুত ওঠানামা করতে পারে। ফলস্বরূপ একই সঙ্গে বিপক্ষের উইং ব্যাকদের প্রেস করে এসেই উইঙ্গারদের সামলে নিতে পারে। মাঝখানে তিন ব্যাক সিস্টেম ফলে যেই যেখান দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করুক না কেন, উইং বা মাঝখান সেখানে সবসময় এনফোর্সারের সামনে দুজন ডিফেন্ডার থাকবেই।
মিড ব্লক আর ডিফেন্স লাইনের মধ্যে গ্যাপ খুব বেশি হবে না, ফলত মাঝের হাফ স্পেসে বল প্লেয়ারদের খুব বেশি কিছু করার জায়গা থাকবে না। সঙ্গে একটা দ্রুত গতির ফরোয়ার্ড, একটা দশ বা আট নম্বর যে দ্রুত প্রতিআক্রমণে বল হোল্ড করবে এবং স্ট্রাইকারকে ফাইনাল পাস বাড়াবে। এর সঙ্গে রয়েছে সেটপিসের দক্ষতা।
এদের ডিফেন্স ভাঙা অত সহজ নয়, কারণ গোল রক্ষকও দারুণ। সমার তো আবার বেশ কিছুদিন ধরেই বিশ্বসেরাদের একজন।
তা এ হেন সার্বিয়া আর সুইজারল্যান্ড ব্রাজিলেরই গ্রুপে। এবং সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে এমনিতেই পাঁপড়ের মতো পাতলা সাইড ব্যাক তালিকায় ড্যানিলোর চোট অপর দিকে যে লোকটা হাফস্পেসে দুর্দান্ত খেলে এবং একটা স্ট্রাকচার্ড ডিফেন্সকে ঘেঁটে দেয় সেই নেয়মার জুনিয়রেরও চোট।
তিতের দল নির্বাচন দেখলে বোঝা যায় যে গত বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের কাছে হার এবং গত কোপায় আর্জেন্টিনার কাছে হারটা এখনও বিনিদ্র রজনী উপহার দেয় তাঁকে।
যদিও পাকেতাকে একটু নিচে রেখে নেয়মারকে হাফস্পেসে ৮ নম্বর হিসাবে খেলিয়ে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণত্মক ছিলেন তিনি। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ডাবল ডিফেন্সিভ পিভটে ফ্রেডকে দলে এনে পাকেতাকে নেয়মারের দায়িত্ব দিলেন তিনি। অপর দিকে রাইট ব্যাকে ড্যানিলোর জায়গায় মূলত সটপার ব্যাক এডার মিলিতাও।
খেলা শুরু হতে দেখা গেল, ব্রাজিল বাঁ দিকে ওভারলোড করছে। ভিনিসিয়াসকে রথের রশি দিয়ে একটু নিচে থেকে অপারেট করছেন, অ্যালেক্স স্যান্দ্রো আর ফ্রেড। সামান্য ডানদিকে পাকেতা এবং আরেক্টু নিচে ক্যাসিমেরো।
ডিফেন্স লাইন স্বাভাবিকভাবেই তিন ব্যাকে চলে যাচ্ছে কারণ সুইজারল্যান্ডের জেতার ইচ্ছা ছিলই না। কোনও রকমে ড্র করতে পারলেই তারা খুশি। তাই আলাদা করে দুই স্টপার রাখার প্রয়োজন পড়ছিল না। কিন্তু সুইজারল্যান্ডের মিড লাইন আর লাস্ট লাইনের মাঝে যে ফাঁকা হাফস্পেস, তার ব্যবহার পাকেতা ভালো করে করতে পারছিলেন না। ফলাফল রিচার্লিসনও খুব কার্যকরী হচ্ছিল না।
ব্রাজিলের জন্য বেশ চিন্তার রাফিনহার ফর্ম। রাফিনহাকে দুই ডিফেন্ডার মিলে চেপে দিলেই তিনি ইনভার্ট করে ভিতরে ঢুকে লো লাইনের উপর দিয়ে বল রাখবার চেষ্টা করছিলেন ভিনির জন্য। অথচ ভিনিসিয়স জুনিয়র আউটসাইড ইনসাইড করে বাইরেও বেরচ্ছিলেন এবং ভিতরেও কাট করছিলেন। কিন্তু সুইস ডিফেন্স খুব দ্রুত নিজেদের স্ট্রাকচার ঠিক রেখে লোব্লকে চলে যাচ্ছিল যেখান থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা রিচার্লিসনের ছিল না। যেটা হতে পারত তা হল বক্সের বাইরে থেকে শট নেওয়া।
তা রাফিনহার একটা দুর্বল শট ছাড়া প্রথমার্ধে এসব নিয়ে বলার কিছু নেই। ভিনিসিয়সও একটা সহজ সুযোগ হাতছাড়া করেন। কিন্তু সার্বিকভাবে তিতে একটা সাবধানী অ্যাপ্রোচ নিয়েছিলেন প্রথমার্ধে। যেটা মনে হয় অমূলক।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই পাকেতার জায়গায় রড্রিগো নামিয়ে ভুল শোধরান তিনি। রড্রিগো হাফ স্পেসে নড়াচড়া শুরু করলে খেলাটা ভাঙতে শুরু করে। সুইসরা দ্রুত প্রতিআক্রমণে উঠে ওদের এক স্ট্রাইকার ছটফটে দীর্ঘদেহি ক্যামেরুনীয় এমবোলোকে অ্যাক্টিভেট করার চেষ্টা করল। জাকা বল নিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এখানেই কার্যকরী হয়ে দাঁড়ালেন থিয়াগো সিল্ভা।
থিয়াগো সিল্ভাকে যখন পিএসজি দলে রাখল না, তখন আমার মনে হয়েছিল সঠিক সিদ্ধান্ত, কারণ থিয়াগো সিল্ভা প্রথম ট্যাকল বা কভারিং-এ এতটাই সময় নিচ্ছিলেন যে দ্রুতগতির ফরোয়ার্ড ঢুকে পড়ছিল এবং পিএসজিকে লো ব্লক করতে হচ্ছিল, যেখানে সামান্য ভুলচুকেই গোল খাবার সমস্যা। কিন্তু এই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই দেখতে পাচ্ছি বিপক্ষ প্রতি আক্রমণে পৌঁছলে মার্কিনহোসকে পিছনে কভার হিসাবে রেখে থিয়েগো সিল্ভা স্ট্রাইকারের আগে পৌঁছচ্ছেন বল ইন্টারসেপ্ট করার জন্য।
আর তার সঙ্গে রয়েছেন ক্যাসেমিরো। যেকোনো ধরণের বিপক্ষের আক্রমণের সম্ভাবনাকে চেন টেনে নামিয়ে দেবার ক্ষমতা ক্যাসেমিরোর আছে। আর তার সঙ্গে রয়েছে পরিষ্কার ফুটবল খেলা। ম্যানচেস্টারে টেন হ্যাগের কোচিং-এ এসে ডিস্ট্রিবিউশনও বেশ ভাল হয়েছে তাঁর।
বল থিয়েগো সিল্ভাকে ছেড়ে বেরিয়ে এলে মারকুইনহোস বা মিলিতাওয়ের গতি সেই বল পুনরুদ্ধারে সাহায্য করছিল। আর সেটপিসে ব্রাজিলের লো ব্লক অনেক সহজে ম্যানেজ করা যাচ্ছে। উচ্চতায় বেশি হলেও আল্পস বা বলকান বিপক্ষকে ফ্রি হেডারের জায়গা দেননি দুটো ম্যাচেই ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডাররা।
৪৫ থেকে ৭৫ মিনিট রড্রিগো, ব্রুনো আর জেসুস নামতেই খেলা ঘুরে গেল পুরোটাই। ব্যাপারটা আন্দাজ করে সুইস কোচ নিজের হাতের তাসগুলো ফেলতে থাকেন এবং মাঝমাঠ জমাট করতে শুরু করেন। কিন্তু ব্রাজিল তখন খেলাটা ছড়াচ্ছে। অ্যান্টনি আসায় ডানদিকটাও সচল হল।
তার আগে অবশ্য একটা সুযোগ এসেছিল ভিনির কাছে, যা তিনি কাজেও লাগান। কিন্তু অফসাইড পজিশন থেকে ফিরে রিচার্লিসন আক্রমণটায় সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ার কারণে গোলটি বাতিল হয়ে যায়।
ডিফেন্সে চাপ কমছে, সুইজারল্যান্ড ড্রয়ের জন্য খেলছে, এই অবস্থায় শেষ সুযোগটা নিলেন তিতে। ক্যাসিমেরোকে ছ নম্বর থেকে আটে পাঠিয়ে দিলেন। ব্রুনো নিচ থেকে খেলা তৈরি করতে শুরু করলেন। রড্রিগো আর জেসুস ডিফেন্ডারদের ব্যস্ত রাখতে শুরু করলেন ফলস্বরূপ ক্যাসিমেরোর ভলি। নেইমার এই ব্রাজিলের হৃদয় আর উইঙ্গাররা দুই ডানা হলে এই ব্রাজিলের ফুসফুস ক্যাসেমিরো। অত ছোট জায়গায় নিখুঁত টেকনিকে বলটা অত জোরে মারলেন, সামান্য ডিফ্লেকশন হলেও ওই শট বাঁচাবার ক্ষমতা সমারের ছিল না।
নেইমার এই দলে অপরিহার্য নয়। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বড় দলের সঙ্গে টাইট সিচুয়েশনে ম্যাচ বার করার মতো ক্রিয়েটিভিটি এই দলে আর কারও নেই। নেই নেইমারের ভিশনও। কিন্তু তার মধ্যে থেকেই ম্যাচ বার করার ক্ষমতা এই ব্রাজিলের আছে, তিতের ব্রাজিল। নাই হতে পারেন চ্যাম্পিয়ন। কিন্তু ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ব্রাজিল সেজেছে আরও শক্ত চ্যালেঞ্জের জন্য। তারপর দেখা যাক। এখনও হাতে পেদ্রোর মতো একটা লুকনো তাস রয়েছে।
এই বিশ্বকাপে খেলাটা অন্যরকম হচ্ছে। ভালো খেলেও একই গতিতে খেলার জন্য কোরিয়া বা কানাডার মতো দল দাঁত ফোটাতে সক্ষম হচ্ছে না। কিন্তু সেই দলগুলিই দূর অবধি যাবে, যাদের রিজার্ভ বেঞ্চ দারুণ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী যারা খেলা বদলাতে সক্ষম।