ব্রাজিলের ভক্তরা রাগ করবেন কিন্তু আমার স্বপ্নের বিশ্বকাপ ফাইনালে ফ্রান্স আর আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হবে। উদ্দেশ্য একটাই – মেসি আর এমবাপ্পের মুখোমুখি লড়াই দেখা। মেসি ইতোমধ্যে সর্বকালের সেরাদের দলে নিজের জায়গা করে ফেলেছেন।
একমাত্র বিশ্বকাপ ছাড়া সব বাক্সতেই তার টিক দেওয়া হয়ে গেছে। অন্যদিকে এমবাপ্পের অনেককিছু পাওয়া, অনেককিছু করা বাকি। তবে মেসির যে ঘর ফাঁকা, সেই ঘরে এমবাপ্পে টিক দিয়ে রেখেছে বছর চারেক আগেই।
সাম্প্রতিক ফর্মের বিচারে এই সমরে বাপ্পের এবং ফ্রান্সের এগিয়ে থাকার কথা। তবে যেহেতু অন্যদিকের খেলোয়াড়টার নাম মেসি, নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।
এই প্রসঙ্গে একটা ম্যাচের কথা খুব মনে পড়ছে। ২০০৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, ব্রাজিল বনাম ফ্রান্স। অনেকের হয়ত মনে থাকবে এই বিশ্বকাপের কথা – সেই জিদানের বিখ্যাত ঢুঁ মেরে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। আইনক্সের বিশাল স্ক্রিনে দেখেছিলাম সেই অদ্ভুত দৃশ্য। বেদনারও।
সেই গল্প না হয় অন্যদিন। সেদিনের ম্যাচের কথায় ফিরে আসি। দুই দলেই স্টারের ছড়াছড়ি। একদিকে জিদান, অঁরি, রিবেরি, অন্যদিকে রোনালদো, রোনালদিনহো, কাকা, কাফু, কার্লোস। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পর প্রথম দেখা ব্রাজিল – ফ্রান্সের। শেষ ম্যাচে ফ্রান্স ৩-০ ব্যাবধানে জিতলেও মাঝখানে অর্থাৎ ২০০২-এর বিশ্বকাপ ব্রাজিল দখল করেছে চিরশত্রু জার্মানিকে হারিয়ে।
তাছাড়া জিদানের ফর্মও পড়তির দিকে। বয়সও হচ্ছে – ৩৪। দেখলে মনে হয় আরও অনেকটাই বেশি কারণ মাথার চুলের আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। সুতরাং অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল ব্রাজিল অনেকটাই এগিয়ে।
ম্যাচ আরম্ভের আগে টিভির স্ক্রিনে দেখাচ্ছে জিদান আর রোনালদো হাসিমুখে কথা বলছে একে অন্যের সঙ্গে। দুজনেই অল টাইম গ্রেট। জিদানের খেলার মধ্যে একটা রাজসিক আভিজাত্য ছিল। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে খেলতেন।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, পেয়েও যেতেন। আলতো পায়ে শুন্য থেকে বল নামিয়ে নিয়ে এসে অসাধারণ ড্রিবলিং করে ডিফেন্ডারদের অনায়াসে পেরিয়ে যেতেন। কিন্তু এই পেরনোর মধ্যে কোন তাড়াহুড়ো নেই। বরং কিছুটা আলস্য, কিছুটা তাচ্ছিল্য থাকত।
অন্যদিকে রোনালদো ছিলেন গোল করার জন্যে বিখ্যাত। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ওর থেকে বিপদজনক ফুটবলার আজ অব্দি দেখি নি। বিস্ফোরক গতি, অসাধারণ বলের ওপর নিয়ন্ত্রন, দুর্দান্ত শুটিং – সব মিলিয়ে কমপ্লিট স্ট্রাইকার।
আগের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের জয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল রোনাল্ডোরই। তার ওপর এবার পাশে পেয়েছেন রোনাল্ডিনহোকে। এর ড্রিবলিংও দর্শনীয়। অনেকের মতে এই বিশ্বকাপ রোনাল্ডিনহোর বিশ্বকাপ হতে চলেছে।
খেলা আরম্ভ হল। এবং প্রায় আরম্ভ থেকেই সবাই বুঝে গেল যে আজকে অন্যরকম কিছু একটা হতে চলেছে। সময়কে পেছনে ঘোরানোর লক্ষ্যে আজ নেমেছেন জিদান। ড্রিবলিং করে ডিফেন্ডারদের মাটিতে ফেলে ঢুকে পড়ছেন পেনাল্টি বক্সের মধ্যে।
আলতো পায়ে মাথার ওপর থেকে বল নামিয়ে আনছেন, তারপর জাগলিং করে বাড়িয়ে দিচ্ছেন সতীর্থের উদ্দেশ্যে। কখনও বা বল ধরেই বোঁ করে একপাক ঘুরে দিক পরিবর্তন করে ধরা ছোঁওয়ার বাইরে চলে যাচ্ছেন ডিফেন্ডারদের।
অথবা পায়ের আলতো টোকায় ছোট্ট লব করছেন প্রতিপক্ষ ফুটবলারের মাথার ওপর দিয়ে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই জিদান ওর পেছনে বল ধরে এগিয়ে গেছেন বেশ কিছুটা। একবার স্বয়ং রোনালদোর মাথার ওপর দিয়ে এই কাণ্ড ঘটালেন। এই সঙ্গে রয়েছে ট্রেডমার্ক ফ্লিক – কখনও পায়ের চেটো, কখনও গোড়ালি দিয়ে। যখন দরকার নেই তখনও। যেন আজ নিজের সম্পত্তি বিলিয়ে নি:স্ব হবেন বলেই মাঠে নেমেছেন সম্রাট।
শুধু দর্শকরাই নয়, ব্রাজিলের স্টার স্টাডেড লাইন আপও সেদিন মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছিল জিদানের সেই সম্মোহনকারী ফুটবল। আর হ্যাঁ, এরই মধ্যে তার ফ্রি কিক খুঁজে পেয়েছিল সুযোগসন্ধানী অরিকে। ম্যাচের একমাত্র গোল করতে ভুল করেন নি সেদিন অরি। অরির মোট ৫১ গোলের মধ্যে একমাত্র এটার পেছনেই জিদানের সরাসরি অবদান রয়েছে।
ম্যাচের শেষে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য। ব্রাজিলের রবিনহো (পরিবর্ত ফুটবলার হিসেবে এই ম্যাচে নেমেছিলেন তিনি) উচ্ছসিত হয়ে ছুটে আসছেন জিদানের দিকে, মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি বলছেন, ‘গুরু, করেছ কী!’ হাসতে হাসতে তার মাথা আদর করে নেড়ে মাঠের বাইরের দিকে হাঁটা দিয়েছিলেন জিদান।
মেসি-বাপ্পের সম্মুখ সমরেও এরকম কিছু একটা ঘটার সম্ভাবনা কিছুটা হলেও থাকছে। বা হয়ত আর্জেন্টিনার ডিফেন্স সেদিন উড়ে যাবে বাপ্পে ঝড়ের সামনে। জাদুকরের শেষ ম্যাজিক বা এক প্রজন্মের থেকে পরের প্রজন্মের মধ্যে ব্যাটনের হাতবদল – যেটাই হোক, এবারের বিশ্বকাপ একটা অন্য মাত্রা পাবে এই ম্যাচ হলে।