সময়টা বেশ দীর্ঘ। সময়ের হিসেবে ১৮ টা বছর। দিন গণনায় সেটা ৬৭৪৭ টা দিন! এতটা সময় পেরিয়ে পর্তুগালের সাইডবেঞ্চে দেখা মিলল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর। দৃশ্যটা অচেনা নয়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়েই এই মৌসুমের এমন সব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে।
কিন্তু, পর্তুগাল বিশ্বকাপের নক আউট স্টেজে খেলছে। আর সেই ম্যাচের শুরুর লাইনআপে রোনালদো নেই। রোনালদোর জার্সির উপরিভাগে রয়েছে বদলি খেলোয়াডের এক পোষাক। এমন এক দৃশ্য বড্ড বেমান। নিষ্ঠুরতার বাস্তব চিত্রায়ন বললেও ভুল হয় না।
রোনালদোবিহীন পর্তুগাল ম্যাচটা জিতেছে দারুণ দাপট দেখিয়েই। রোনালদোর জায়গায় একাদশে যিনি এসেছিলেন তিনি আবার হ্যাটট্রিক করে চলে এসেছেন আলোচনায়। সবমিলিয়ে অনেকের মতেই, রোনালদোর বিদায়ঘন্টার ক্ষণ গণনা শুরু হয়ে গেছে। সমস্যাটা বেঁধেছে, এই প্রজন্ম যেভাবে রোনালদোকে নিজেদের মাঝে লালন করেছে সেই রোনালদোকে এভাবে তারা দেখতে অভ্যস্ত নয়।
তাই মুহূর্তের মধ্যে এমন রঙ বদলে যাওয়াটায় কেউই সেভাবে তটস্থ হতে পারেনি। এখনো সেই ঘোরেই তারা আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে এই ভেবে যে, পর্তুগাল খেলছেন, কিন্তু সেই ম্যাচে রোনালদো মাঠে নেই! এমন সব বিস্ময়কর, অভাবনীয় মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার অনভ্যস্ততাটাই ভাবনার গভীরতা বাড়িয়েছে। আবেগাক্রান্ত করেছে, সব কিছু ছাপিয়ে সুইসদের বিপক্ষে রোনালদোর সাইডবেঞ্চে বিষণ্ন থাকার ছবিগুলোই ভক্তদের বিমর্ষতায় ঘিরে ফেলেছে।
কিন্তু সব কিছুর একটা শেষ আছে। নক্ষত্রদের পতন হয়, তেমনি কিংবদন্তীদেরও প্রস্থান হয়। এই প্রস্থানে কোনো অবনমন নেই। বরং রোনালদোর সব কীর্তিগাঁথায় এই পর্তুগাল যে আজকের অবস্থানে এসেছে সেই দৃষ্টিতে রোনালদো বহু আগেই পর্তুগিজ জার্সি গায়ে শিখরে পৌঁছে গেছেন। কখনোই কোনো মেজর শিরোপা না জেতা পর্তুগালকে সেই ইতিহাসের সাথেই পরিচয় করিয়েছেন।
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো ইউরো জিতেছিল পর্তুগাল। সে ফাইনাল ম্যাচে মোটে ২৫ মিনিট খেলেছিলেন রোনালদো। কিন্তু ফাইনাল ম্যাচে ইনজুরির কারণে রোনালদোর অশ্রুসিক্ত হয়ে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার সে দৃশ্য ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম সুন্দর এক স্থিরচিত্র হয়ে আছে। রোনালদো সেখানেই থামেননি, জিতিয়েছিলেন আরেকটি শিরোপাও, উয়েফা ন্যাশনস কাপ। তো পর্তুগালকে এই শূন্য থেকে শিখরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখানোর পথে মধ্যমণি ছিলেন এই রোনালদো।
ইউসেবিও হয়ে লুই ফিগো, সবাই পর্তুগালকে ফুটবল মানচিত্রে একটা জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পর্তুগালের ফুটবল অগ্রযাত্রায় তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু রোনালদো তাদের ছাপিয়ে পর্তুগালকে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তাই সাইডবেঞ্চের রোনালদোর বসের থাকার দৃশ্য মোটেই লজ্জাদায়ক কিছু নয়। বরং সেটা অতি গর্বের।
সুইজল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে রামোস যখন একের পর এক গোল করছিলেন, তখন পিটার ড্রাউরি মাইক্রোফোন হাতে কমেন্ট্রি বক্স থেকে বলছিলেন, রামোসের এই গোলবন্যা দেখে নিশ্চিতভাবেই রোনালদো গর্বিত হবেন। একদম যথার্থ বলেছেন তিনি। এই রামোসরাই তো রোনালদোর উত্তরসূরি। ভবিষ্যতের এমন জয়গান দেখে তাই রোনালদোর গর্বিত হওয়াই উচিত।
এখন ইতিহাস কী বলে? ইতিহাস বলে, সব কিংবদন্তীদের বিদায় সব সময় মধুর হয়নি। ম্যারাডোনার শেষের শুরুটা হয়েছিল ডোপ টেস্টে পজিটিভ হয়ে, জিনেদিন জিদান শেষ করেছিলেন লাল কার্ড খেয়ে, জিয়ানলুইজি বুফন শেষ করেছিলেন গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার হতাশা নিয়ে।
রোনালদোর ক্ষেত্রে শেষের গল্পটা কেমন হবে তা এখনো বলা কঠিন। কারণ তাঁর পর্তুগাল এখনো শিরোপা রেসেই আছে। তবে মাঠের রোনালদোর শেষের শুরুটা হয়ে গেছে নিশ্চিতভাবেই। আর এখানে এসে সব কিংবদন্তীদেরও আটকে যেতে হয়। কেউ বিদায় বলে দেন সময় বুঝে, কেউ বিদায় বলতে সময় নেন, বিলম্ব করেন। পর্তুগালে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে রোনালদো নিজের সম্ভাব্য বিদায়ক্ষণের ঘোষণা এখন পর্যন্ত দেননি। তাই পর্তুগালের জার্সি গায়ে সে যাত্রাটা এখনো চলমান বলেই ধরে নেওয়া যায়।
তবে ক্রীড়াঙ্গনে মাথা উঁচু করে বিদায় নেওয়ার একটা চল আছে। এমন কিছুর ব্যত্যয় করে কেউই তেমন তাদের ক্যারিয়ার লম্বা করতে পারেননি। বরং নিজের ইগোইজমের কারণে দলের উপর চাপ বাড়িয়েছেন। কারো কারো কাছে আবার চক্ষুশূলও হয়েছেন। তাই আউটডোরের এ সব স্পোর্টসে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে হয় ঐ ছন্দ দিয়েই। নিজের নাম কিংবা ব্র্যান্ড দিয়ে যতটুকু টিকিয়ে রাখা যায় তার স্থায়িত্ব বেশিদিন থাকে না।
ধ্রুব এক সত্যের মুখোমুখি ঠিকই সবাইকে দাঁড়াতে হয়। কারণ এই খেলাধূলার প্রাঙ্গনটা বাস্তবতার মোড়কে নিষ্ঠুর এক জায়গা, বড্ড বেশি স্বার্থপরতার একটা মঞ্চ। এখানে অতীত সুখস্মৃতির দাম খুবই কম। সেটা শুধু রোমন্থনের মধ্যেই আটকে থাকে। কারণ প্রত্যেকটা দলই তাদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। এখানে অতীত নিয়ে আটকে থাকার উদাহরণ খুব কমই।
তাই এমন সব পরিস্থিতি রোনালদোরও আমলে নেওয়া প্রয়োজন। তবে রোনালদো তো একজন চ্যাম্পিয়ন ফুটবলার । তিনি জানেন কখন কী করতে হয়। কিভাবে ফিরে আসতে হয় সেটি তাঁর খুব ভালভাবেই জানা। এখন বয়স কিংবা গোটা বিশ্বের ভাবনাকে ভুল প্রমাণ তিনি আবার স্বরূপটা দেখানোর একটা চ্যালেঞ্জ নিতেই পারেন।
তবে, সেই সব চ্যালেঞ্জের বৈপরীত্যে রয়েছে অনেক আশঙ্কাও। কারণ রোনালদো এখন ক্যারিয়ারের মধ্যগগণ পেরিয়ে পার করছেন গোধূলি লগ্ন। এখন এই সময়টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ফিরে আসাটা তাঁর জন্য বড্ড কঠিনই বটে।
রোনালদো এখন সেই কাঠিন্যের মাঝ দিয়ে যাবেন নাকি শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক নিয়ে বিদায় বলে দিবেন ফুটবল মাঠ থেকে, সেটি সময়ই বলে দিবে। আপাতত এক কিংবদন্তীর শেষের পথচলাটুকু শুধু উপভোগ করা যাক। হোক সেটা তাঁর মাঠে দাপিয়ে বেড়ার দৃশ্যে, কিংবা সাইড বেঞ্চের সরব উপস্থিতিতে।