শচীনকে ছাপিয়ে যাবেন কোহলি?

চট্টগ্রামের পর গুয়াহাটি- ঠিক এক মাসের ব্যবধানে টানা দুই ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরি করলেন বিরাট কোহলি। অথচ এই সেঞ্চুরি খরাই কিনা একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তাঁকে পেয়ে বসেছিল। ২০১৯ সালের ১৪ আগস্টে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের ৪৩ তম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন। তবে এর পরের ওয়ানডে সেঞ্চুরিটার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১২১৬ টা দিন!

দীর্ঘ সময় পর কোহলির সে ওয়ানডে সেঞ্চুরিটা এসেছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে। আগের মত ধারাবাহিক নন। সেটার নমুনা মিলেছিল টেস্ট সিরিজেই। রঙিন পোশাকে উজ্জ্বল কোহলি বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে হয়ে গেলেন বিবর্ণ। তাই কোহলি বন্দনা সে সময় শুরু হতে না হতেই মিইয়ে যায় নানাবিধ সমালোচনায়।

কিন্তু কোহলিরা তো একেবারে ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। কিংবা ব্যর্থতার বেড়াজালে আবদ্ধ থাকা কোনো ক্রিকেটার নয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচেই হাঁকালেন সেঞ্চুরি। অর্থাৎ তিন বছরেরও বেশি সময় ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরিহীন থাকা কোহলি পর পর দুটি ওয়ানডে ম্যাচে পেলেন সেঞ্চুরির দেখা।

ভিন্ন দুটি দুটি সিরিজ। সময়ের ব্যবধানও ঠিক এক মাস। তারপরও ব্যাক টু ব্যাক ওয়ানডে সেঞ্চুরির কীর্তি। এমন কীর্তি অবশ্য বিরাটের জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগে আরও নয় বার ব্যাক টু ব্যাক ওয়ানডে সেঞ্চুরির এ কীর্তি তিনি দেখিয়েছেন।

গুয়াহাটিতে এ সেঞ্চুরির করার পথে অর্ধশতক পূরণ করেছিলেন ৪৭ বলে। তবে তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল ফিগার ছোঁয়াতে এ দিন যেন আরো আগ্রাসী হয়ে ওঠেন কোহলি। সেঞ্চুরি পূরণ করেন ৮০ বলে। অর্থাৎ পরের ৫০ রান করতে খেলেছেন মাত্র ৩৩ টি বল। আর এতেই ক্যারিয়ারে ৪৫ তম সেঞ্চুরির দেখা পান কোহলি।

ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে যা আর কেউ পারেনি তা থেকে বিরাট আর মাত্র কয়েকটি সেঞ্চুরি দূরে। আর ৫ টি সেঞ্চুরি করলেই ইতিহাসের প্রথম ব্যাটার হিসেবে ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরির হাফ সেঞ্চুরি করবেন বিরাট কোহলি। এখন পর্যন্ত ৪৯ টি সেঞ্চুরি নিয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিয়ানদের তালিকায় শীর্ষে আছেন শচীন টেন্ডুলকার।

শচীন টেন্ডুলকারের কথাই যখন আসলো তখন একটা প্রশ্ন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই উদয় হতে পারে। বিরাট কোহলি কি শচীনকে টপকে যেতে পারবেন? পুরো আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার বিবেচনায় হয়তো শচীনকে পেছনে ফেলাটা বেশ কষ্টসাধ্যই হবে কোহলির জন্য।

কারণ এটা সত্যি যে, বিরাট কোহলি তাঁর সোনালি সময় পেছনে ফেলে এসেছেন। এই মুহূর্তে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সেঞ্চুরি সংখ্যা ৭৩ টি। শচীনের ১০০ সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙাটা বর্তমান ক্রিকেট কাঠামো বিবেচনায় কোহলির জন্য বেশ কঠিন। তবে সেটা মোটেই অসম্ভব কিছু নয়।

তবে এ ক্ষেত্রে বিরাট কোহলির বিপরীতে যাওয়ার মত বেশ কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে। একটু বিস্তরভাবে বললে, শচীনের সময়টায় ক্রিকেটের পুরোটাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কেন্দ্রিক ছিল। খেলোয়াড়রা তাদের দেশের জন্য খেলতে মুখিয়ে থাকতেন। সমস্ত পরিকল্পনা ঐ ওয়ানডে আর টেস্টকে নিয়েই ছিল। তাই সংখ্যার বিচারে নব্বই দশকের ক্রিকেটাররা পরিসংখ্যানের দিক দিয়েও বেশ সমৃদ্ধ ছিলেন।

কিন্তু, বর্তমান ক্রিকেট বেশ খানিকটা বদলে গেছে। খেলার ঊর্ধ্বে বিজনেস মডেলে পরিণত হয়েছে সেটাও এক অর্থে বলা যায়। টেস্ট, ওয়ানডের পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি যুক্ত হয়েছে। ফ্রাঞ্চাইজি লিগ গুলো প্রভাব বিস্তার করা শুরু করেছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটটা এখন আর আগের মত নেই। সব কিছু মূলত বিভাজিত হয়ে গেছে। যার ফলে এফটিপি অনুযায়ী দেশগুলোর ওয়ানডে ম্যাচ কমতে শুরু করেছে। বিরাট কোহলির ক্ষেত্রে মূলত এই সব বিষয়গুলোই প্রধান বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

প্রথমত একজন ক্রিকেটারের ফরম্যাট ভেদে পূর্ণ প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু তিন ফরম্যাটের ব্যস্ত সূচিতে ঠাসা থাকলে পারফরম্যান্স পড়তির দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য ভারত, ইংল্যান্ডের মত দেশগুলোর ক্রিকেটাররা নিজে থেকেই বেশ কিছু সিরিজে বিশ্রাম নিয়ে থাকেন।

এই যেমন কোহলিই বেশ কিছু বছর ধরে নিচু সারির কোনো দলের সাথে সিরিজে খেলেন না। বেছে বেছে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ আর টুর্নামেন্ট গুলোতে খেলে থাকেন। যার ফলে শচীন তাঁর ক্যারিয়ারে যেভাবে স্বত:স্ফূর্ত ভাবে খেলে গিয়েছেন সেটা বর্তমান সময়ের বিবেচনায় বিরাট কোহলির জন্য সম্ভব না।

তবে সব দিক দিয়েই কি শচীন টেন্ডুলকার এগিয়ে থাকবেন? সম্ভবত না। কারণ শচীনের ওয়ানডে সেঞ্চুরির রেকর্ডটা ভাঙার বেশ কাছেই আছেন বিরাট কোহলি। নিজেকে আর কয়েকটা বছর ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসে শচীনকে বেশ ভালভাবেই পেছনে ফেলে দিতে পারেন বিরাট কোহলি।

এই যেমন বিরাট তাঁর এই ৪৫ তম ওয়ানডে সেঞ্চুরিটি পূরণ করলেন ২৫৭ তম ইনিংসে। অথচ শচীনে ৪৫ টা সেঞ্চুরি করতে খেলেছিলেন ৪২৪ টি ইনিংস। এখানেই বড় একটা ব্যবধান তৈরি করেছেন কোহলি। যদিও রানের দিক দিয়ে শচীনকে টপকাতে এখনও প্রায় ছয় হাজার রান করতে হবে তাঁকে। এখন পর্যন্ত ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বিরাটের রান ১২৫৮৪। আর শচীনের রান ১৮৪২৬।

তবে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গুয়াহাটিতে এই সেঞ্চুরি দিয়ে শচীন টেন্ডুলকারের আরেকটি রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন কোহলি। ঘরের মাঠে শচীনের ২০ সেঞ্চুরির রেকর্ডকে ছুঁয়েছেন তিনি। তবে এই ২০ সেঞ্চুরির জন্য শচীন ১৬৪ টা ম্যাচ সময় নিয়েছিলেন, সেখানে বিরাট সময় নিলেন ১০২ টি ম্যাচ।

পঞ্চাশ ওভারের এই ফরম্যাটেই শচীন টেন্ডুলকারকে বিরাট কোহলি বেশ ভাল ব্যবধানেই পেছনে ফেলেছেন আরেকটি জায়গায়। সেটি হল- সফল রান চেজের ক্ষেত্রে শচীন টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি যেখানে ১৪ টি, সেখানে বিরাট কোহলির সেঞ্চুরি ২২ টি!

বিরাট কোহলি ওয়ানডে ক্রিকেটে মাইলফলক স্পর্শ করার বিবেচনায় এগিয়ে থাকলেও টেস্টে আবার বেশ পিছিয়ে। টেস্ট ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত কোহলি রান করেছেন ৮১১৯। তো সেই আট হাজার রান পূরণ করার মাইলফলক বিবেচনায়, শচীন টেন্ডুলকার তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে আট হাজার রান পূরণ করেছিলেন ১৫৪ তম ইনিংসে। আর কোহলির ৮ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করতে লেগেছিল শচীনের চেয়ে ১৫ ইনিংস বেশি, ১৬৯ ইনিংস।

তবে, ওয়ানডে ফরম্যাট বিবেচনায় আবার এগিয়ে যান বিরাট কোহলি। শচীন যেখানে ৩০০ তম ইনিংসে ১২০০০ রান পূরণ করেছিলেন সেখানে বিরাট কোহলি ১২০০০ রান করতে লেগেছিল ২৪২ টি ইনিংস। মোদ্দাকথা, একজন ওয়ানডেতে এগিয়ে তো সেই তিনিই আবার টেস্টে ঢের পিছিয়ে।

শচীন টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলি- দু’জন ভিন্ন দুই সময়ের ক্রিকেটার। দিন শেষে তাই ঠিক তাদের মধ্যে তুলনাটা যায় না। তবে ক্রীড়াঙ্গন মানেই তো রেকর্ড ভাঙা গড়ার উপাখ্যান। তো সেই হিসেবে বিরাট কোহলি কতটুকু পথ পাড়ি দিলেন কিংবা শচীনের সমস্ত রেকর্ড তাঁর জন্য কতটা দূরের পথ সেই দূরত্বসীমা সংখ্যাতত্ত্বের ভিত্তিতে একটা খেরোখাতা দাঁড় করানোই যায়। যত যাই হোক, শচীন টেন্ডুলকার তো এই বিরাটের হাতেই নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাটন তুলে দিয়েছিলেন। তাই এমন আলোচনা কিংবা বিশ্লেষণ অনুমিত ভাবেই হওয়ার দাবি রাখে।

বয়স, ফর্ম, সময়, সক্ষমতা- সবকিছুর একটা সংমিশ্রণ হলেই এই বিরাট কোহলি যেতে পারেন আরো বহুদূর। পেছনে ফেলতে পারেন শচীন টেন্ডুলকারকেও। এমন ভবিষ্যদ্বাণী চাইলেই দেওয়া যায়। তবে সেটা না হলেও, বিরাট কোহলি নিশ্চিতভাবে গ্রেটদের কাতারেই থাকবেন। তারপরও বোলারদের বিপক্ষে আগ্রাসনের সংজ্ঞা হয়ে থাকা এই বিরাট কোহলির আগ্রাসন আরও বেশ কিছু বছর চলতে থাকুক- এই আকাঙ্ক্ষাটা বোধহয় এখন সবচেয়ে জরুরি।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link