হালকা নেওয়া আলতো শটে,
জোর সে কিছু ছিল বটে।
আর জোরে নেওয়া কিছু শটে,
চার, ছয় আঁকা হত পটে।
বীরেন্দ্র শেবাগ, রোহিত শর্মাদের একজন আদিপুরুষ ওপেনার ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে, একদা। অলৌকিক সব কাণ্ডকারখানা ঘটত তাঁর অস্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক মার মার কাট কাট ব্যাটিংয়ের সুবাদে। এবং তা এতটাই স্বাভাবিকভাবে ঘটে যেত যে মনেই হত না, সেগুলো ঘটেছে। শুধু কয়েক ওভারের মধ্যেই তিনি মাটি করে দিতেন প্রতিপক্ষর আনন্দ উৎসব। তিনি হলেন কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত।
কত কত নতুন নতুন উদ্ভাবনী শট যে দিনের আলো দেখত তার ব্যাটিংয়ের দৌলতে, তাঁর কোনো হিসেব নেই। রিভার্স সুইপ মারায় ভারতীয় ক্রিকেটে পথিকৃত ছিলেন তিনি। খেলা দেখতে আসা দর্শকদের জন্য আশির দশকে ব্যাটিংয়ে বিনোদনের ভরপুর ম্যাটিনি আইডল ছিলেন তিনিই। হাত আর চোখের অলৌকিক সামঞ্জস্য এবং অসম্ভব দ্রুত রিফ্লেক্সের যোগফলে তার ব্যাটিংকে বিশ্বের তাবড় বোলারদের সামনে টক্কর নেওয়ার মত সাবলীল দেখাত।
১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতের সর্বোচ্চ ৩৮ করার পথে তখনকার বিশ্বত্রাস অ্যান্ডি রবার্টসের বলে হাঁটু গেঁড়ে মারা ঐ স্ক্যোয়ার কাট-টা কোনদিন ভুলবেনা ভারতীয় ক্রিকেট। ভারতীয় ক্রিকেট এটাও কোনদিন ভুলবেনা যে, ১৯৮৫ সালের বেনসন হেইজেস কাপে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া আর ফাইনালে পাকিস্তানের বোলারদের শুরু থেকেই মার খাবার দুঃস্বপ্ন দেখানো ব্যাটসম্যানও (৫ ম্যাচে ১ বার অপরাজিত থেকে ২৩৮ রান) ছিলেন তিনিই।
অধিনায়ক হয়ে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানে গিয়ে সিরিজ ড্র রাখাও (নিজের ৭ ইনিংসে শোচনীয় ৯৭ রান সহ) ভুলবেন না কেউই, কোনদিন। ১৯৮৮ সালে ভাইজাগে কিউইদের বিরুদ্ধে এক ওয়ানডে ম্যাচে ৭০ রান আর ৭ ওভারে ২৭ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেওয়াও স্মৃতির মণিকোঠায় উজ্জ্বল থেকে যাবে, বহুদিন।
১০ বছরেরও বেশি খেলে (১৯৮১-১৯৯২) ৪৩ টেস্টে দু’টো সেঞ্চুরি আর ১২ টি হাফ সেঞ্চুরি-সহ ২০৬২ রান আর ১৪৬ ওয়ানডেতে চারটি সেঞ্চুরি আর ২৭ টি হাফ সেঞ্চুরি-সহ ৪০৯১ রান, সঙ্গে ২৫.৬৪ গড়ে ২৫ টি ওয়ানডে উইকেট দিয়ে তাকে মাপা যায়না। তার ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট (টেস্টে ৭৫.৩৪ আর ওয়ানডেতে ৭১.৭৫) দিয়ে তো নয়ই।
শুরু থেকে মার, মাঝখানে মার, শেষের দিকেও মার, এই ব্যাটিং দর্শন ছিল তার বোলারদের জন্য রাখা উপহার। মার খেয়ে বেদম হয়ে যাওয়া বোলারদের জন্য শুধু থাকত একটিই লাইফলাইন, তার খুব বেশিক্ষণ উইকেটে থাকতে চাওয়ার অনীহা।
এটাই ছিল একমাত্র কারণ, তার ৩৩ বছর বয়সে অবসর নেওয়া আর ‘নট সো ইম্প্রেসিভ’ ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যানের পিছনে। ‘ধারাবাহিকতা’ শব্দটা আর তিনি ছিলেন দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। গোটা ক্যারিয়ারজুড়েই এই ‘দুর্নাম’ ছিল শ্রীকান্তের।
ভারতীয় ক্রিকেটের মতই তাঁর ব্যাটিং কোনোদিন ভুলবেন না একজন ভারতীয় ওপেনারও, যার নাম সুনীল গাভাস্কার। তাঁর উল্টোদিকে সবচেয়ে বেশি দিন জুড়ি থাকা এই কিংবদন্তি ওপেনারের কথা অনুযায়ী, তাঁর হাতে ব্যাট থাকলে মাথা উড়ে যাবার আশঙ্কায় যারপরনাই বিপন্ন বোধ করতেন হেলমেটহীন সুনীল গাভাস্কার। ‘পিচে ব্যাট হাতে কাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেতেন?’ – এই প্রশ্নের জবাবে কোন বোলার নন, এই লেখার মুখ্য চরিত্রের নাম করেছিলেন সানি।