জাতীয় দল, আইপিএল, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, এ দল কিংবা সার্ভিস দল তো দূর, রঞ্জি ট্রফিতেই মাস খানেক আগে অভিষেক হয়েছে মহেশ পিথিয়ার। নাগিচানা নামের প্রত্যন্ত এক গ্রামে তাঁর বাস। অথচ এই মহেশই কিনা গত কয়েকদিন যাবত আছেন ভারত সফরগামী অস্ট্রেলিয়া দলের সাথে। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের সাথে তাঁর বোলিং অ্যাকশনের মিল আছে- স্রেফ এই কারণেই ভাগ্য বদলে গেছে এই অফস্পিনারের।
মহেশ তাঁর জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটি দেখেন গ্রামের চায়ের দোকানে। সেটা ছিল ওয়াংখেড়েতে ক্রিকেটকে বিদায় জানানো শচীন টেন্ডুলকারের শেষ টেস্ট। সবার নজর তাই ক্রিকেট ঈশ্বরের উপর থাকলেও মহেশ চমকে যান ভারতের এক অফস্পিনারকে।
‘আরেহ! অশ্বিন আর আমি তো একই অ্যাকশনে বল করি!’, মহেশের প্রথম অভিব্যক্তি ছিল এটাই। অথচ সেদিনের আগে কখনোই অশ্বিনের বোলিং দেখেননি মহেশ। এক দশক বাদে এই মিলটাই বদলে দিয়েছে মহেশের জীবন।
নাগপুরে শুরু হতে যাওয়া টেস্ট সিরিজের আগে অস্ট্রেলিয়া দল হন্যে হয়ে একজন স্পিনারকে খুঁজছিল যার অ্যাকশনে কিনা মিল আছে অশ্বিনের সাথে। এরপরই মহেশের স্বপ্নযাত্রা শুরু। তিনি বলেন, “গত দুইদিনের বেশিরভাগ সময় আমি স্টিভেন স্মিথকেই বল করেছি। আমি বল করতে শুরু করতেই তিনি বুঝে যান আমি অশ্বিনের মতো একই অ্যাকশনে বল করি। এরপর সে আমার বল খেলতে মুখিয়ে ছিল।” এছাড়া তাঁর দাবি সে নেটে স্মিথকে বেশ কয়েক বার আউটও করেছেন।
গত ডিসেম্বরেই বরোদার হয়ে মধ্য প্রদেশের বিপক্ষে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়েছে ২১ বছর বয়সী মহেশ। দিন কয়েক আগে বরোদার ভিডিও অ্যানালিস্ট অস্ট্রেলিয়ার সহকারি কোচ আন্দ্রে বরোভাককে তাঁর বোলিংয়ের একটি ভিডিও পাঠালে আলোচনায় আসেন মহেশ। অ্যানালিস্ট প্রতেশ যোশি বলেন, ‘আমার কাছে ভালো স্পিনারদের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তাই মহেশের ভিডিও পাঠিয়েছিলাম। অশ্বিনের অ্যাকশনের মিল থাকার পাশাপাশি সে নিজেও একজন ভালো স্পিনার।’
এরপরই বদলে যায় মহেশের জীবন। গত কয়েক দিনে তাঁর উপর দিয়ে রীতিমত ঝড় বয়ে গেছে, একের পর এক সাংবাদিক উন্মুখ হয়ে ছিলেন তার সাক্ষাৎকার নিতে। এমনকি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইটেও তাঁকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে তাঁকে, বাড়িতে পর্যন্ত যোগাযোগ করেছেন দুই দিন পর।
নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছেন না মহেশ। অজিদের সাথে একই হোটেলে ওঠার পর নিজেকে রীতিমত চিমটি কেটে দেখেছেন স্বপ্ন না সত্যি। তিনি বলেন, “জুনাগড় থেকে খুব বেশি ক্রিকেটার উঠে আসে না। তাই বড় স্বপ্ন দেখা তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য সুযোগ সুবিধা বেশ কম। তবে আমরা টেনিস বলে প্রচুর ম্যাচ খেলি।’
মহেশের ক্রিকেটের প্রেমে পড়া মূলত বড় ভাই দিনেশকে দেখে। গ্রামের মাঠে টেনিস বলে খেলে বেড়ে উঠলেও দুই ভাইয়ের লক্ষ্যটা ছিল বড় স্তরে নিজের প্রতিভার জানান দেয়া। মহেশ একদিন জানতে পারেন তাদের পাশের গ্রাম থেকে দুইজন পোরবান্দারে ক্রিকেট হোস্টেলে সুযোগ পেয়েছে। এরপর থেকেই তাঁর ভাই তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ট্রায়ালে যেতে উৎসাহিত করে।
পোরবান্দারে ছয় মাস থাকার পর এক কোচের পরামর্শে বরোদাতে চলে আসেন মহেশ। সেই সিদ্ধান্তই মোড় ঘুরিয়ে দেয় তাঁর ক্যারিয়ারের। মহেশের ভাষ্যমতে, ‘এনকে শর্মা নামের একজন কোচ আমাদের একাডেমিতে এসেছিলেন। তিনিই আমাকে পরামর্শ দেন বরোদাতে চলে আসার। আমি তাঁর কথা শুনেই এখানে চলে আসি। এরপর প্রথমে বরোদার বয়স ভিত্তিক দলে খেলি। তারপর তো রঞ্জিতেই অভিষেক হয়ে যায়।’
অস্ট্রেলিয়ানরা ইতোমধ্যেই তাঁকে অশ্বিন নামে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে। আসল অশ্বিনের মত ক্যারম বল না জানলেও মহেশের বোলিংয়ের মূল শক্তি আর্ম বল আর ব্যাকস্পিন ডেলিভারি।
অজিরা নাগপুরে প্রথম টেস্টের জন্য উড়ে যাওয়া পর্যন্ত দলের সাথেই থাকবেন মহেশ। এরপর তিনিও ফিরে যাবেন নিজের গন্তব্যে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সেরা দলের বিপক্ষে বল করতে পারা আমার জীবনের অপ্রত্যাশিত এক সুযোগ। আমি এর থেকে অনেক কিছুই শিখেছি, কিন্তু আমাকে ক্যারিয়ারে আরো অনেক দূর যেতে হবে।’
বরোদার হয়ে খেলার সময়ও পরিবারের সাথে মাঠে কাজ করবেন মহেশ। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা মাঠে আখ এবং ভুট্টা চাষ করি। আমি এখনো মাঠে কাজ করি। কারোরই নিজের শিকড়কে ভুলে যাওয়া উচিত নয়।’