এডো ব্রান্ডেস, জিম্বাবুয়ের ‘প্রথম’ গল্পের নায়ক

১৯৭৯ সালের শেষের দিককার কথা। রোডেশিয়া তখন জিম্বাবুয়ে হওয়ার পথে। প্রেসিডেন্ট পদে ইয়ান স্মিথের জায়গায় আসলেন অ্যাবেল মুজোরেওয়া। তৎকালীন রোডেশিয়ার স্বাধীনতার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখনই। অবশেষে ১৯৮০ সালে স্বাধীনতা লাভের ফলে রোডেশিয়া পরিণত হয় জিম্বাবুয়েতে।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে নতুন একটা যুগের শুরু হয় সে বছর থেকেই। এক বছর বাদে আইসিসি’র সহযোগী সদস্যপদ লাভ। এরপর ১৯৮৩ সালে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে সব কিছুই দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার উপর আবার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিল তারা। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত একটা শুরু।

তবে জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে দারুণ শুরুর রেশ আর বেশিক্ষণ গড়ায়নি। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২- টানা তিন বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করলেও তেমন একটা সফলতা মিলছিল না দলটার। তবে জিম্বাবুয়ের জন্য সোনালি অধ্যায় রচিত হয় নব্বই দশকে। পাইক্রফট, হটন আর ফ্লাওয়ার ব্রাদার্সদের নিয়ে দুর্দান্ত একটা দল হয়ে উঠছিল জিম্বাবুয়ের। এর মাঝে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ১৯৯২ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে। আর সেই বছরেই হারারে স্পোর্টস ক্লাবে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টেস্ট আঙিনায় পা রাখে জিম্বাবুয়ে।

জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে প্রথম টেস্ট। শুরুটাও হলো স্মরণীয়। প্রথমবারের মতো টেস্ট খেলতে নেমেই স্কোরবোর্ডে ৪৫৬ রান যোগ করলো জিম্বাবুয়ের ব্যাটাররা। সাথে বেশ কয়েকটা কীর্তিও গড়লো জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটাররা। প্রথম টেস্ট খেলতে নামা মানেই তো ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া, অসংখ্য কীর্তির হাতছানি।

তো প্রথম কীর্তিটা আসলো গ্রান্ট ফ্লাওয়ারের কাছ থেকে। জিম্বাবুয়ের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ফিফটি করলেন তিনি। আর অধিনায়ক ডেভ হাটন করলেন প্রথম সেঞ্চুরি। তবে ফিফটি, সেঞ্চুরির মতো কীর্তির পাশাপাশি বিব্রতকর রেকর্ডও তো ইতিহাসের পাতায় বন্দী হয়।

জিম্বাবুয়ের ইতিহাসে টেস্টে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শূন্যরানে আউট হলেন এডো ব্রান্ডেস। তবে তিনি শুধু বিব্রতকর শূন্যের পাশে ‘প্রথম’ তকমায় আটকে থাকলেন না। জিম্বাবুয়ের হয়ে প্রথম লাল বল হাতে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। আরেকটু ভেঙে বললে, জিম্বাবুয়ের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে বল হাতে প্রথম ডেলিভারিটি করেছিলেন এডো ব্রান্ডেস।

প্রথম শূন্যরান আর প্রথম বল- জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে এ দুইয়ের ‘প্রথম’-এ মিশে থাকা এডো ব্রান্ডেসের জন্ম একটা কৃষক পরিবারে। ব্রান্ডেসের বাবার রক্তে ক্রিকেট কোনোদিনই ছিল না। তারপরও ব্রান্ডেস জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে শুরুর গল্পের ইতিহাস হয়ে আছেন।

এডো ব্রান্ডেসের ক্রিকেট যাত্রার গোড়াপত্তন সেই প্রাইমারী স্কুলে পড়া অবস্থা থেকেই। ব্রান্ডেস তখন গ্রেড ফাইভে পড়েন। তো একদিন তাঁর স্কুলে তৎকালীন রোডেশিয়ার ক্রিকেটার ব্রায়ান ডেভিডসন আসলেন। ব্যাস। ডেভিডসনকে দেখেই একটা অনুপ্রেরণা খুঁজে নিলেন ব্রান্ডেস। নিয়মিত অলিতে গলিতে ক্রিকেট খেলা শুরু করলেন। ফলও মিলল দ্রুতই। ১৯৭৫ সালে রোডেশিয়ার ন্যাশনাল প্রাইমারি স্কুলের দলে জায়গা পেলেন।

এরপর থেকেই ব্রান্ডেসের ছুটে চলা শুরু। অনূর্ধ্ব-১৫ দলে সুযোগ পেলেন। ইন্টার স্কুল টুর্নামেন্টে সেঞ্চুরি হাঁকালেন। এরমধ্যে রোডেশিয়া জিম্বাবুয়েতে পরিণত হয়েছে। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটও নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে।

তো, ১৯৮২ সালে এডো ব্রান্ডেস জিম্বাবুয়ের স্কুল টিমের মূল দলে খেলার সুযোগ পেলেন। এর কিছু বছর বাদে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ব্রান্ডেস এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করলেন। পিটারমারিতজবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হলেন। তবে ক্রিকেটটা ঠিকই চালিয়ে গেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের দলে খেলা শুরু করলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন অবস্থাতেই ব্রান্ডেস হারারে ক্রিকেট লিগে সুযোগ পেলেন। সে লিগে ব্রান্ডেস খুব একটা ভাল করলেন না। ব্যাটে কিংবা বল, কোনোটাতেই নিজেকে খুঁজে পেলেন না। তাই ঐ টুর্নামেন্টের পরে হতাশা জেঁকে বসেছিল ব্রান্ডেসের উপর।

এরপরেই ক্রিকেট ছেড়ে একটা ফার্নিচারের দোকানে কাজ নেন ব্রান্ডেস। কিন্তু কী এক নিয়তি! সেই দোকানের মালিক আবার ক্রিকেট খুব পছন্দ করতেন। তিনি ব্রান্ডেসকে আবারো ক্রিকেট খেলার জন্য উৎসাহিত করতে থাকলেন। আর সেই উৎসাহেই প্রিন্স এডওয়ার্ড বয়েজ ক্লাবে আবারো ফিরে আসেন ব্রান্ডেস।

এডো ব্রান্ডেসের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একটা মোড় আসে ১৯৮৬ সালে। সে বার ওয়েস্ট ইন্ডিজের তরুণ দল জিম্বাবুয়েতে খেলতে আসলো। আর সেই দলে সুযোগ পেলেন এডো ব্রান্ডেস। সুযোগ পেয়েই বাজিমাত। সিরিজের তৃতীয় ম্যাচেই নিলেন ৫ উইকেট। এরপর পাকিস্তান বি দলের বিপক্ষে সিরিজে ৩ ম্যাচেই নিলেন ১৭ উইকেট।

টানা দুই সিরিজে দুর্দান্ত খেলা এডো ব্রান্ডেসের এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে একটি কীর্তি গড়লেন তিনি। জিম্বাবুয়ের প্রথম বোলার হিসেবে যেটি ছিল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করার কীর্তি।

জিম্বাবুয়ের হয়ে এডো ব্রান্ডেসের মূল পরিচিতিটা বোলার হলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর বিধ্বংসী রূপ দেখা গেছে ব্যাটিংয়েও। জিম্বাবুয়ের মূল দল তখন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ খেলতে ব্যস্ত। আর এডো ব্রান্ডেস জিম্বাবুয়ের বোর্ড দল নিয়ে কিম্বার্লিতে। গ্রিকুয়াল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ।

বোলার ব্রান্ডেস সেদিন যেন হয়ে উঠলেন একজন পুরোদস্তুর একজন ব্যাটার। ১০ ছক্কা আর ১৫ চারে সাজালেন ১৬৫ রানের অপরাজিত একটি ইনিংস। এই এক ইনিংসেই ব্রান্ডেস সেবার অস্ট্রেলিয়া সফরে জায়গা পেয়েছিলেন। কিন্তু অজানা কোনো এক কারণে সিরিজের মাঝ পথেই সেবার দেশে ফিরে আসতে হয় ব্রান্ডেসকে।

জিম্বাবুয়ের হয়ে খুব বেশি ম্যাচ খেলা হয়নি এডো ব্রান্ডেসের। ১০ টা টেস্ট আর ৫৯ টা ওয়ানডেতেই আটকে গিয়েছে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। অবশ্য ইনজুরি তাঁকে খেলতে দেয়নি বললেও খুব একটা ভুল বলা হয় না। তবে ছোট ক্যারিয়ারেও পেয়েছেন কিছু তুলে রাখার মতো স্মৃতি। ৯২ এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে মাত্র ১৩৫ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দেয় জিম্বাবুয়ে। এমন পরিস্থিতিতে ম্যাচ জয়ের ভাবনা আনাই এক অকল্পনীয় ব্যাপার। কিন্তু জিম্বাবুয়েকে সেই পথে নিয়ে গেলেন এডো ব্রান্ডেস।

প্রথমে গ্রাহাম গুচকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেললেন। এরপর একে একে রবিন স্মিথ, গ্রায়েম হিক আর অ্যালান ল্যাম্বকেও ফেরালেন। ইংল্যান্ডের দ্রুত উইকেট পতনের ফলে ততক্ষণে ম্যাচ ঝুঁকে যায় জিম্বাবুয়ের দিকে। এবং দিনশেষে জয়টা পায় জিম্বাবুয়েই। ১৩৪ রান করেও ৯ রানে ম্যাচে সে ম্যাচটি জিতে নেয় জিম্বাবুইয়ানরা। আর ২১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে সে ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন এডো ব্রান্ডেস।

ব্রান্ডেসের আরেক সোনালি স্মৃতির সাথে এই ইংল্যান্ডই জড়িত। ১৯৯৭ সালে এই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ক্যারিয়ারের একমাত্র হ্যাটট্রিকটি পেয়েছিলেন তিনি। যেটি আবার জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসেরও প্রথম হ্যাটট্রিক ছিল। হারারের মাটিতে ব্রান্ডেসের সেই হ্যাটট্রিক যাত্রায় শিকার হয়েছিলেন নি নাইট, ক্রাউলি আর নাসের হুসাইন।

৮৭ তে অভিষেক, ১৯৯৯ এ এসে অবসর- এডো ব্রান্ডেসের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সময়কাল এই এক যুগই। ইনজুরি প্রবণতা বারবারই ভুগিয়েছে এই পেসারকে। এজন্য ক্যারিয়ারও তেমন দীর্ঘ হয়নি। একই সাথে ক্যারিয়ারের পাশে সংখ্যা গুলোও বড়ো হয়নি। তারপরও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের পর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট চালিয়ে গিয়েছিলেন ব্রান্ডেস। ২০০১ সাল পর্যন্ত খেলেছিলেন।

কিন্তু এরপরেই জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটে দৈন্যদশা শুরু হয়। জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় বর্ণবাদ রাজনীতি। আর এরপর থেকেই ধুঁকতে থাকে দেশটির ক্রিকেট। এডো ব্রান্ডেসের ক্যারিয়ারও তখন পড়ন্ত বেলায়। তাই ঘরোয়া ক্রিকেটও আর জোর করে টানতে চাননি তিনি। ক্রিকেট ছেড়েছেন ২০০১ সালে। এরপর দেশও ছেড়েছেন। পাড়ি জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়াতে।

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে গিয়ে ক্রিকেটটাও নিজের মাঝে লালন করেছিলেন। ঝুঁকেছিলেন কোচিংয়ে। যদিও কোচিং ক্যারিয়ারে ব্রান্ডেসের পথ তেমন অগ্রসর হয়নি। এরপর ফিরে গিয়েছেন বাপ দাদাদের পেশাতেই। অস্ট্রেলিয়ায় একটা টমেটোর ফার্ম রয়েছে তাঁর। সেই ফার্ম নিয়ে এখন দিব্যি চলে যাচ্ছে এডো ব্রান্ডেসের।

জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসে এডো ব্রান্ডেস বড়ো কোনো নাম নয়। তবে শুরুর সময়ের জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটে যে কজন হাল ধরেছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। জিম্বাবুয়ের প্রথম টেস্ট দলের গর্বিত সদস্য তিনি।

শুধু তাই নয়, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট ইতিহাসে অনন্তকাল ধরে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, জিম্বাবুয়ের হয়ে সাদা জার্সি গায়ে প্রথম লাল বল হাতে ডেলিভারিটি করেছিলেন এডো ব্রান্ডেস। শুধু কি তাই, প্রথম হ্যাটট্রিকটাও যে এসেছিল তারই হাত ধরে। এডো ব্রান্ডেস এই সব অনন্য অর্জনেই মহিমান্বিত, স্মরণীয়। আর এই অনন্য অর্জনগুলো তো মুছে যাবার নয়। কারণ ইতিহাসের ‘প্রথম’ সব কিছুই ঐতিহাসিক আর অক্ষত।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link