ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় দ্বৈরথ কোনটি? কোনো কিছু না ভেবেই হয়তো উত্তর দেয়া যায় এই প্রশ্নের। ভারত-পাকিস্তানে লড়াইয়ের উত্তেজনা আর আবেদনকে পুরোপুরি ছাড়িয়ে যেতে পারেনি আর কোনো দ্বৈরথই।
শারজায় জাভেদ মিয়াদাদের শেষ বলে ছক্কা কিংবা মুলতানে বীরেন্দ্র শেবাগের ট্রিপল সেঞ্চুরি অথবা হালের বাবর আজম আর মোহাম্মদ রিজওয়ানের ১৫১ রানের জুটিতে পাকিস্তানের ১০ উইকেটের জয়, ক্রিকেট ইতিহাসে ভারত পাকিস্তানের লড়াই মানেই ভক্তদের জন্য চিরদিন মনে রাখার মত কিছু স্মৃতি।
শুধু মাঠের লড়াই নয়, ভারত পাকিস্তানের লড়াইয়ের উত্তাপ বাড়িয়ে দেয় দুই দেশের রাজনৈতিক কোন্দল। রাজনৈতিক কোন্দলে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ আছে এক যুগ ধরে। কিন্তু এই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ বন্ধ থাকাটা যেন লড়াইয়ের উত্তাপে আঁচ বাড়িয়েছে আরো। দীর্ঘদিন পর পর কোনো আইসিসি ইভেন্টে যখনই এই দুই দল মুখোমুখি হয় তখনই সেই ম্যাচের আবেদন থাকে আকাশচুম্বি।
যদিও ৯০ এর দশক কিংবা নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকে ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের যে উত্তেজনা সেটি যেন খানিকটা হলেও হারিয়ে গেছে। ওয়াসিম আকরাম আর শচীন টেন্ডুলকারের মুখোমুখি লড়াই কিংবা সাকলাইন মুশতাক, অনিল কুম্বলেদের লড়াই গুলো তখন নিয়মিতই দেখা যেত। তখন নিয়মিতই অনুষ্ঠিত হত দ্বিপাক্ষিক সিরিজ। তাই টেস্ট ক্রিকেটে এই দুই দলের মুখোমুখি লড়াই ছিল দর্শকদের চরম আরাধ্য।
ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সিরিজ গুলোর মধ্যে অন্যতম স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের ভারত সফর। পুরো সিরিজেই একের পর এক অবিস্মরণীয় পারফরম্যান্স দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। সেঞ্চুরি করেও শচীনের ভারতকে জেতাতে না পারা কিংবা এক ইনিংসেই অনীল কুম্বলের ১০ উইকেট শিকার অথবা সাকলাইন মুশতাকের একাই ভারতকে হারিয়ে দেয়ার স্মৃতি গুলো ঠাই করে নিয়েছে ক্রিকেটের স্মরণীয় মুহুর্তগুলোর মধ্যে।
১৯৯৯ সালের সেই সিরিজের প্রথম টেস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল চেন্নাইতে। চেন্নাই টেস্টে শচীনের সেই দুর্দান্ত ১৩৬ রানের ইনিংস তাঁর ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা। কিন্তু অমন অসাধারণ ব্যাটিং করেও দলকে জেতাতে পারেননি শচীন। দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ানো পাকিস্তানের টেস্ট ইতিহাসেরও অন্যতম সেরা ম্যাচ হয়ে আছে সেটি।
সেই টেস্টে পাকিস্তানের জয়ের নায়ক সাকলাইন মুস্তাক এক সাক্ষাৎকারে তুলে আনলেন সেই ম্যাচের ভেতরকার গল্প। কিভাবে শচীনকে আউট করে পাকিস্তানকে ম্যাচে ফিরিয়ে এনে জয় এনে দিয়েছিলেন সেই ঘটনাই এবার জানালেন ইউটিউবের একটি পডকাস্টে।
সাকলাইন বলেন, ‘চেন্নাই টেস্ট পাকিস্তানের ইতিহাসের সেরা টেস্ট ছিল। প্রথম ইনিংসে আমি শচীনের প্রথম বা দ্বিতীয় বলেই তাকে আউট করি। পরের ইনিংসে যখন সে ব্যাটিংয়ে এলো তখন ম্যাচের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। প্রথম দশ ওভারে শচীন কোনো শটই খেলেনি। তাঁর বিরুদ্ধে আমার কৌশলগুলো সে খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিল। আমি অফ স্পিন, দুসরা, টপ স্পিন, আর্ম বল, ফ্লাইটেড ডেলিভারি সবই চেষ্টা করেছি কিন্তু প্রথম ১০-১২ ওভার সে খুব সচেতন ভাবে খেলছিল। এরপর থেকেই সে আমাকে আক্রমণ করতে শুরু করে।’
শচীনের আক্রমণে কিছুটা ভরকে যান সাকলাইন। তখন তিনি কথা বলেন অধিনায়ক ওয়াসিম আকরামের সাথে। সেই কথোপকথন নিয়ে সাকলাইন বলেন, ‘তখন আমি ওয়াসিম আকরামের কাছে যাই। গিয়ে তাকে বলি, ওয়াসিম ভাই, আমার মনে হয় সে আমাকে খুব ভালো ভাবে মোকাবেলা করছে। আমাকে সরিয়ে নিয়ে অন্য কাউকে আক্রমণে নিয়ে আসুন।’
ওয়াসিম আকরাম তখন সাকলাইনকে বলেন, ‘ভাই, যাই হয়ে যাক না কেন তুমি এই প্রান্ত থেকে বোলিং করবে। আমি আর কাউকে বিশ্বাস করি না। যদি এই ম্যাচ আমাদের দিকে ঘোরে তাহলে সেটা তোমার জন্যই ঘুরবে।’
ওয়াসিমের এই কথায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পান সাকলাইন। সেই ইনিংসে জয়ের জন্য ২৭১ রান তাড়া করছিলো ভারত। কিন্তু ওয়াকার ইউনুস আর সাকলাইন মুস্তাকের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি ভারতের টপঅর্ডার। ৮২ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে তখন খাদের কিনারায় ভারত। তখনই নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি খেললেন শচীন। একাই এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন ভারতকে।
১৩৬ রানের অবিস্মরণীয় ইনিংসে যখন ভারতকে প্রায় একাই জিতিয়ে ফেলছিলেন শচীন। পাঁচ উইকেট হাতে রেখে তখন মাত্র ৩৭ রান প্রয়োজন ভারতের। তখনই শচীনকে আউট করে পাকিস্তানকে জয়ের পথে নিয়ে আসেন সাকলাইন। হাত থেকে প্রায় বেরিয়ে যাওয়া সেই ম্যাচে শচীনের স্বপ্নভঙ্গ করে জিতে যায় পাকিস্তান।
সাকলাইন বলেন, ‘পরের ১০-১২ ওভারে আমি তাকে কোনো ভ্যারিয়েশন করিনি। আমি এক নাগাড়ে অফস্পিন করতে থাকি একই ধরণের ফিল্ডিং সেট করে এবং প্রথম দশ ওভারে সে আমার ব্যাপারে যা যা পর্যবেক্ষণ করেছে তা ভুলে যায়। পরের ওভারগুলোতে আমি কোনো দুসরা করিনি। তখম আমি একটি দুসরা ডেলিভারি করি এবং শচীন সেটিতে মারতে যায়। ততক্ষণে সে ১৬-১৭ টি বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সেই বলটায় শচীনের ব্যাটের কানায় লাগে এবং ওয়াসিম সেই ক্যাচটি ধরে।’
এভাবে শচীনের মত সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটারকে ফাঁদে ফেলে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেটটি শিকার করেন সাকলাইন। শচীনের আউটের পর ভেঙে পড়ে ভারতের টেল এন্ডার। শেষ পর্যন্ত প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচটাও জিতে নেয় পাকিস্তান।