ধ্বংসপ্রায় বাংলাদেশকে পথ দেখানোর নায়ক

ততদিনে এডি বারলো বাংলাদেশ ছেড়েছেন। হুইলচেয়ারকে সঙ্গী বানিয়ে নিজের সাথে আর পেরে উঠছিলেন না। তাই না চাইতেও বাংলাদেশ নামক প্রেমে মশগুল হওয়া এ মহাপ্রেমিককে দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে হলো।

বাংলাদেশ ক্রিকেটে এডি বারলোর প্রস্থান ঘটলো। এরপর একে একে এলেন ট্রেভল চ্যাপেল, মহসিন কামালরা। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে গতি তো এলোই না, বরং উল্টোপথে পথ হারাতে শুরু করলো বাংলাদেশ। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন গোলকধাঁধায় পড়ে গেল দেশের ক্রিকেট।

ম্যাচের পর ম্যাচ প্রতিপক্ষের কাছে নতি স্বীকার। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির ততদিনে তিন বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কোনো টেস্ট ম্যাচে জয় তো দূরে থাক, টানা ৪০ টা ওয়ানডে ম্যাচ পরাজয়ের তিক্ততায় ডুবে গিয়েছে বাশার-সুজনরা। এর মধ্যে আবার ২০০৩ বিশ্বকাপে অসহায় আত্মসমর্পণ। কানাডার মতো সহযোগী দেশের সাথেও হারলো বাংলাদেশ। এমন একটা অবস্থা, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধের মুখে পড়েছে তখন। এমন সময়ে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিতে আসলেন একজন আধা অস্ট্রেলিয়ান-আধা শ্রীলঙ্কান, ডেভ হোয়াটমোর।

ডেভ হোয়াটমোর, নামটা তখন কার কাছেই বা অচেনা! ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপজয়ের নেপথ্যের নায়ক। তাঁর অধীনেই সেবার অর্জুনা রাণাতুঙ্গা, রোশান মহানামা, অরবিন্দ ডি সিলভারা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায়।

বিশ্বকাপ জয়ী কোচ। নামের পাশে তাই হাই প্রোফাইল কোচ তকমা বসাতে বিশেষ কোনো মানদণ্ডে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এমন মানের কোচ কিনা ভঙ্গুর একটা দলের দায়িত্ব নিবেন! বিশ্ব গণমাধ্যমে এ নিয়ে তাই আলোচনা কম হলো না। কিন্তু ডেভ হোয়াটমোর সে সব আলোচনা যেন পাত্তাই দিলেন না। নতুন পরিচয়ে বাংলাদেশে যখন কলম্বো থেকে উড়াল দিলেন তখন বললেন, ‘আশা করছি ভাল কিছু হবে। আমি ওদের নিয়ে হোমওয়ার্ক করেছি। ভাল সম্ভাবনা আছে।’

একটা দল, যারা জেতাই এক প্রকার ভুলে গিয়েছে, পরাজয়ের তিক্ত স্বাদে যাদের বাইশ গজ বিষাদের চাদরে ঢেকে গিয়েছে, তাদেরকে নিয়ে ঠিক কোন সম্ভাবনা খুঁজে পেলেন হোয়াটমোর? ক্রিকেট বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সমর্থকরা এক প্রকার ভেবেই নিল, ট্রেভর চ্যাপেল, মহসিন কামালদের মতো হোয়াটমোরও বেশিদিন টিকবেন না। ফাঁকা বুলি তো তারাও দিয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের এসে হোয়াটমোরের সাফ কথা, জয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিলেন হোয়াটমোর। বাংলাদেশের দায়িত্বে তাঁর প্রথম মিশন ছিল নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সেই সিরিজের দুটি টেস্টেই হেরেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে দারুণ লড়াই করেছিল হাবিবুল বাশাররা। ওয়ানডে সিরিজেও প্রতিপক্ষ বিবেচনায় বেশ ভাল লড়াই করেছিল বাংলাদেশ।

মূলত এরপরেই বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট। ডেভ হোয়াটমোরের ছোঁয়ায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে শুরু করে ক্রিকেটাররা। সেই চিত্র দেখা গিয়েছিল পাকিস্তান সফরে। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেবার মুলতান টেস্ট তো এক প্রকার জিতেই গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত আর ইনজামামের সেঞ্চুরিতে শেষ পর্যন্ত জয়বঞ্চিত থাকতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। ম্যাচ শেষের পর খালেদ মাহমুদ সুজনের রুমাল দিয়ে কান্না মুছার দৃশ্য তো এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেটে হৃদয় নাড়ানো এক দৃশ্য হয়ে আছে।

ডেভ হোয়াটমোরের অধীনে বাংলাদেশ ভাল খেলা শুরু করেছিল। কিন্ত আকাঙ্খিত সেই জয়ের দেখা ঠিক মিলছিল না। অবশেষে ২০০৪ সালে এসে সেই অপেক্ষা ঘুচে। টানা ৪৭টি ম্যাচ হারের পর জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দীর্ঘ ৪ বছর পর প্রথম জয়ের মুখ দেখে বাংলাদেশ। কিছুটা অবাক কিংবা বিস্ময়ে ভাসানোর মতো তথ্য হলো, টেস্ট স্ট্যাটাসের পর বাংলাদেশের সেটিই ছিল প্রথম জয়।

এরপর সেই ২০০৫। টেস্ট ক্রিকেটে ৫ বছরের শিশু হলেও ততদিনে কোনোমতে হাঁটা চলার জন্য একটি জয়ও যে পায়নি বাংলাদেশ। সেই শুন্যতা কাটলো এ বছরেই। প্রথমবারের মতো টেস্ট জিতলো বাংলাদেশ। জিম্বাবুয়েকে ২২৬ রানে হারিয়ে হোয়াটমোরের শিষ্যরা সেদিন সাদা পোশাকের শুভ্রতা ছড়িয়ে দিল গোটা বাংলাদেশে।

সে বছরে রঙিন গল্পগাঁথার সেখানেই শেষ নয়। কার্ডিফের সবুজ ঘাসগালিচায় আবার ইতিহাস রচনা করলো বাংলাদেশ। তবে এবার প্রতিপক্ষ সেই জিম্বাবুয়ে নয়,মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া। আশরাফুলের চোখ জুড়ানো ১০০ রানের ইনিংসে সেদিন ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল পাঠান, পন্টিংদের চোখ।

তখনকার সময়ে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোই অনেক বড় দলগুলোর জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে মিনোজ তকমায় আটকে থাকা বাংলাদেশ হারিয়ে দিল অজিদের। নেপথ্যের নায়ক এবারও ডেভ হোয়াটমোর। ড্রেসিংরুমে অস্ট্রেলিয়ার পরাজয়ে সেদিন সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত ছিলেন অজিদের হয়ে ৭ টা টেস্ট খেলা সেই হোয়াটমোরই। কারণ ভঙ্গুর বাংলাদেশ দলটাকে যে তিনি নিজ হাতে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিলেন। এমন মুহূর্তের মঞ্চায়নে তাই বাঁধভাঙ্গা উল্লাস তাঁর সাথেই সাজে।

পরের বছর ২০০৬ সালেও বাংলাদেশের দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলা অব্যাহত থাকলো। কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর ঠিক পরের বছরেই ফতুল্লায় অজিদের প্রায় ধরাশায়ী করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। তবে সেটি না হলেও, অস্ট্রেলিয়াকে সে টেস্ট জিততে নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্টদের।

একটা সময় পর্যন্ত পরাজয়ের বৃত্তে আটকে থাকা বাংলাদেশ তখন থেকেই জয়ের একটা অভ্যাস গড়ে তুলতে শুরু করে। এক বছরের ব্যবধানে জিম্বাবুকে এবার ওয়ানডে সিরিজ হারায় বাংলাদেশ। এরপর ২০০৭ বিশ্বকাপে অভাবনীয় সাফল্য পায় দলটা। গ্রুপ পর্বে ভারতকে হারিয়ে তখন পর্যন্ত নিজেদের ইতিহাসে সেরা সাফল্যের সন্ধান পায় বাংলাদেশ। গ্রুপ পর্বের বাঁধা টপকে সুপার সিক্সে উঠে যায় তারা।

এরপর সুপার সিক্সে গিয়ে আবার চমক। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ২০০৭ এর সে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সফল মিশন শেষেই বাংলাদেশের দায়িত্ব ছেড়ে দেন ডেভ হোয়াটমোর। যদিও বিশ্বকাপ শেষে একটি সিরিজের পর আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানান তিনি।

বাংলাদেশের কোচ থাকাকালীন বড় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লড়াই কিংবা জয় ছাড়াও ডেভ হোয়াটমোরের অবদান ছিল আরেকটি জায়গায়। তাঁর সময়েই বাংলাদেশে প্রথম হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের (এইচপি) যাত্রা শুরু হয়। আর সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে দারুণ সব প্রতিভাবান ক্রিকেটার। শাহরিয়ার নাফিসের জাতীয় দলে আগমন ঘটেছিল এইপি ইউনিট থেকেই। তাছাড়া, সে সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট একই সাথে বেশ কজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার পায়। সাকিব, তামিম, মুশফিক, তামিমের জাতীয় দলে অভিষেক হয়েছিল ডেভ হোয়াটমোরের সময়েই। সেই চারজনই এখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সম্মুখ সারির নেতা।

বাংলাদেশের পর পাকিস্তান ও জিম্বাবুয়ের হয়েও কাজ করেছেন ডেভ হোয়াটমোর। এ ছাড়া ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) কলকাতা নাইট রাইডার্সের প্রধান কোচের দায়িত্বও পালন করেছেন। বরাবরই তরুণদের নিয়ে কাজ পছন্দ করেন হোয়াটমোর।

আর সেই চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়েই ২০১৭ সালে ভারতের রঞ্জি ট্রফির দল কেরালার সঙ্গে কাজ করেছিলেন তিনি। যদিও মাস ছয়েক পরেই সে দায়িত্ব ছেড়ে দেন তিনি। এরপর ২০২০ আর ২০২১ সাল- এই দুই বছরে সিঙ্গাপুর, নেপালের হয়ে কাজ করেছেন হোয়াটমোর।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঘোর দু:সময়ে এসেছিলেন ডেভ হোয়াটমোর। কী এক জাদুমন্ত্রে গোটা দলটাকেই বদলে দিয়েছিলেন। দায়িত্ব পাওয়ার দুই বছরের ব্যবধানে প্রথম টেস্ট, অজিবধ- সবটাই এনে দিয়েছিলেন। আর বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ডের গণ্ডি পেরোনের নেপথ্যেও তো তিনিই ছিলেন। পরাজয়ের তিক্ততায় আঁধারে ঢুকে যাওয়া বাংলাদেশকে জয়ের খিদে বাড়ানোর রেসিপিটাও তাঁরই তৈরি করা।

যখন তিনি বাংলাদেশ ছাড়লেন, তখন বিশ্ব ক্রিকেট বাংলাদেশকে দেখে সমীহের চোখে। এই রূপবদলের নায়ককে বাদ দিয়ে কি আদৌ বাংলাদেশ ক্রিকেটের অগ্রযাত্রার খেরোখাতা আঁকা যাবে? নিশ্চিতভাবেই নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের দিন বদলের গানের প্রথম গীতিকার যে তিনিই। যার পদচ্ছাপ মোটা দাগে এর মধ্যেই অঙ্কিত হয়ে গেছে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে। এই ডেভ হোয়াটমোরকে তাই স্মৃতিতে আড়াল করা যায় না। তিনি আজীবন থেকে যাবেন বাংলাদেশের ক্রিকেট নামক পাতায়, কাব্যে কিংবা মহাকাব্যে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link