চিরকালের ফ্রেমে হল তার ঠাই

অনেকদিন আগের কথা। মহেন্দ্র সিং ধোনি তখন কর্মসূত্রে খড়গপুরে। ওর প্রথম ক্যাপটেন কৌশিক (পদবি ভুলে গিয়েছি এখন) বলেছিলেন, ‘দুপুরে পেটে ভাত পড়ল না। আপেল, আঙুর খেয়েই গোটা একটা দিন কাটিয়ে দিত ধোনি।’

কলকাতায় একবার খেলতে এসে গ্র্যান্ড হোটেলে খড়্গপুরের বন্ধুদের নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ধোনি। সেই টমাস, যাঁর দোকানে চা খেতেন, সত্য প্রকাশ-সহ আরও অনেকে এসেছিলেন সেই ডিনার পার্টিতে। শিকড় ভোলেননি ধোনি।

দিন কয়েক আগে শ্রদ্ধেয়া সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তী এখনকার হার্টথ্রব অরিজিৎ সিং সম্পর্কে বলেছিলেন, জিয়াগঞ্জ এলাকার রিকশাচালকদের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব বলিউড-খ্যাত গায়কের। তাঁদের পিঠে হাত রেখে গল্প করেন অরিজিৎ, তাঁদের বলেন, ‘কী রে ভাই, অনেকদিন তো বাড়িতে আসিস না। আয় একবার।’

বিজয় হাজারে ট্রফি খেলতে ধোনি কলকাতায় এসেছিলেন সেকেন্ড টায়ার এসিতে চেপে। বেশিদিন আগের কথা নয়। বছর ছয় আগের কথা হবে। নিজের স্টারডম ইমেজ সরিয়ে রেখে ট্রেনযাত্রা করেছিলেন বিশ্বজয়ী অধিনায়ক।

সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় শ্রীজাত বলেছেন, গানের পারিশ্রমিক হিসেবে এগারো টাকা চেয়েছেন অরিজিৎ। মাত্র এগারো টাকা! প্রবল গরমের হাত থেকে রেহাই পেতে ঘরের এসি চালিয়ে দিতে চেয়েছিলেন শ্রীজাত। বন্দিত গায়ক নাকি বলেছিলেন, ‘তুমি কি ছেলেবেলায় এসিতে দিন কাটিয়েছিলে?’

অরিজিৎ সিং এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মুম্বই বা অন্য শহরে গেলে তিনি গাছ-গাছারি মিস করেন। শহর থেকে আরও  ভিতরে গেলে গাছের দেখা মেলে। হয়তো দূরের কোনও শহরে গাছ দেখতে পেলে নিজের গ্রাম জিয়াগঞ্জের সঙ্গে মিল খুঁজে পান অরিজিৎ।

একটা সাক্ষাৎকারে দেখছিলাম সঞ্চালক নানা ধরনের প্রশ্ন করে চলেছেন অরিজিতকে। উত্তর দিতে চাইছেন গায়ক, অথচ সঞ্চালকের প্রশ্ন শেষ হচ্ছে না। জুড়ে যাচ্ছে অন্য কিছু। অরিজিৎ শান্ত। বিরক্ত না হয়ে উত্তর দিয়ে চলেছেন।

একবার ইডেন গার্ডেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচের আগে এক সাংবাদিক পিছন থেকে পাঁচটা প্রশ্ন করেছিলেন ধোনিকে। সেই প্রশ্নগুলো ছিল কিছু বাঁকা, কিছু সোজা। প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে ধোনি বিরক্তি না দেখিয়ে মুখে ভুবনভোলানো হাসি এনে সেই সাংবাদিককে বলছিলেন, ‘ছুপ ছুপ কর কে পাঁচ সওয়াল কিয়া তু।’ অবসর নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহলী পাপারাজ্জিদেরও জবাব দিয়েছেন হাসতে হাসতে।

হিন্দি বাদে তেলুগু, তামিল-সহ আরও বহু ভাষায় গান গেয়েছেন অরিজিৎ। সেই ভাষাগুলো করায়ত্ত করে গান গাইতে না জানি কত সমস্যাতেই পড়তে হয়েছে বাংলার এই গায়ককে। গায়ক নিজে বলছেন, ‘কিছু ভক্ত থাকেন যাঁরা অন্ধ। আর কিছু হয়তো মনে করছেন, এ আবার কেন গাইল এই গান! ভাষাটাই জানে না, কেন করে এসব।” এতটাই সরল জিয়াগঞ্জের ছেলেটা। বাংলার অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারি দেখলাম লিখেছেন, ‘দ্য সুপ্রিম এক্সসেলেন্স ইজ সিমপ্লিসিটি’।

মনে পড়ছে বন্ধু সাংবাদিক রূপক বসুর কাছে শোনা একটা গল্প। প্রথমবারের আইপিএলে চেন্নাই সুপার কিংসের ম্যাচ কভার করতে চেন্নাইয়ে গিয়েছিলেন রূপক। চিপকে গিয়ে রূপক দেখেন মাঠে বসে গল্প করছেন ধোনি-রায়নারা। সাংবাদিকের মন। এক্সক্লুসিভ করার নেশায় পৌঁছে গিয়েছিলেন ধোনিদের কাছে। দু-চারটে প্রশ্নও তৎক্ষণাৎ করে ফেলেছিলেন ধোনিদের। বিচক্ষণ অধিনায়ক বিনীত ভাবে রূপককে বলেছিলেন, ‘একটু বাদেই প্রেস কনফারেন্স হবে। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর ওখানেই দেব।’ এত সুন্দর এবং ভদ্র ভাবে ধোনি উত্তর দিয়েছিলেন, সেই মুগ্ধতার ঘোর বোধহয় এখনও কাটেনি রূপকের।

আর একবার নিজের এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। হাঁটু মুড়ে বসে দুর্বিনীত আমি প্রশ্ন করেছিলাম তদানীন্তন ভারত অধিনায়ককে। মিডিয়া ম্যানেজার ভাল ভাবে নেননি আমার প্রশ্ন। ধোনি কিছু মনে করেননি। উল্টে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হুইচ ম্যাচ ইউ আর টকিং অ্যাবাউট?’ ভিন রাজ্যে ম্যাচ কভার করতে যাওয়া সাংবাদিকের মন সেদিন আচ্ছন্ন হয়েছিল ধোনিতে।

অরিজিৎ এখন দেশের এক নম্বর গায়ক। শঙ্কর মহাদেবন প্রশংসা করেন। কুমার শানু বলেন, অরিজিৎ আজকের জমানার বিরাট কোহলি। সেই অরিজিৎ নিজে বলছেন, তিনি নাকি এক নম্বর হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। গুরুর জোরাজুরিতে চলে এসেছিলেন গুরুকুলে। সেখানে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ইলা অরুণ তাঁকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্যার আদমি উসকা ছুতা হ্যায় জিসকো ইজ্জত করতা হ্যায়।’

আইপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ধোনিকে সামনে দেখে অরিজিৎ বিশ্বজয়ী অধিনায়ককে প্রণাম করলেন। ওই দৃশ্য দেখে রিওয়াইন্ড মোডে চলে গিয়েছিলাম আমি। আমারও মনে পড়ছিল ইলা অরুণের কথাগুলো, ‘প্যার আদমি উসকা ছুতা হ্যায় জিসকো ইজ্জত করতা হ্যায়।’ মনে পড়ছিল চোখের জল মোছা অরিজিতের মলিন মুখ।

সবাই বলছেন দুই কিংবদন্তির দেখা হল আইপিএলের বোধনের দিন। আমার মনে হচ্ছে, দুই সহজ-সরল মানুষের সাক্ষাত হল। দু’জন ভাল মানুষের দেখা হলে যে দৃশ্য এবং চিত্রনাট্য তৈরি হয়, তা চিরদিনের ফ্রেমে জায়গা করে নেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link