ক্রিকেট ব্যাট আর বলের খেলা।
একজন ক্রিকেটারকে ব্যাট কিংবা বল হাতে দারুণ পারফরম্যান্সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় ক্রিকেট বিশ্বে। কিন্তু ব্যাটিং বা বোলিংয়ে নয় জন্টি রোডস ক্রিকেট বিশ্বে তারকা খ্যাতি পেয়েছিলেন তাঁর অসাধারণ ফিল্ডিংয়ের কারণে।
বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান এবং বোলার নির্বাচন করতে গেলে হয়তো হিমশিম খেতে হবে অনেক সময়। কিন্তু বিশ্বের সেরা ফিল্ডার বাছাই করা যাবে খুব সহজে। এই কাজটা করতে বেশি সময় নিতে হবে না, এক নিমিষেই বলে দেওয়া যাবে তিনি আর কেউ নন; জন্টি রোডস। রোডস এক্ষেত্রে অদ্বিতীয়, এখানে তাঁর সাথে পাল্লা দেওয়ার মত কেউ নাই।
জন্টির এই পথচলাটা শুরুতে এতো সহজ ছিল না। মাত্র ছয় বছর বয়সে মৃদু মৃগীরোগে আক্রান্ত হন। ফলে রাগবি খেলতে দেওয়া হয়নি তাঁকে। ফিল্ডিংয়ের সময় যাতে বল মাথায় আঘাত না করতে পারে সেজন্য শুরুর দিকে হেলমেট পরে ফিল্ডিং করতেন।
বিশ্বের সেরা ফিল্ডারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু ১৯৯২ সালে আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে। সেই আসরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক হয় রোডসের। অভিষেকেই রান আউট করেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রেগ ম্যাকডারনটকে। নিজের প্রথম ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ হয়নি তার। সে ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া থামে মাত্র ১৭০। ছোট এই মামুলি লক্ষ্য তারা করতে নেমে রোডসের দক্ষিন আফ্রিকা মাত্র এক উইকেট হারিয়ে জয় নিশ্চিত করে।
১৯৯২ সালের ক্রিকেটের বিশ্ব আসরে পঞ্চম ম্যাচে নিজের জাত চেনান রোডস। দক্ষিন আফ্রিকান এই ক্রিকেটার পাকিস্তানের বিপক্ষে সেদিন দুর্দান্ত ফিল্ডিং করেছিলেন। তাঁর এক থ্রো বদলে দিয়েছিল ম্যাচের চিত্র। ইনজামাম -উল -হক ও ইমরান খানের দৌড়ের মাঝখানে বলটি ধরে স্টাম্পে থ্রো করেন রোডস। যা বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা চিত্রগুলোর একটি। তাঁর জীবনের সেরা সাফল্যও বটে। ২ উইকেটে ১৩২ রানে থাকা পাকিস্তান, ১৭৩ রান তুলতেই পরের ছয় উইকেট হারায় । ২ উইকেটে ১৩২ থেকে ৮ উইকেটে ১৭৩ দাঁড়ায় পাকিস্তানের স্কোর। দক্ষিন আফ্রিকা জয় পায় ২০ রানে।
বিশ্বকাপে তাঁর এই রান আউট ফিল্ডিং দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছিল। সেদিন ব্যাকয়ার্ড পয়েন্টে দুরন্ত এক ডাইভে বল তালুবন্দি করে স্টাম্পে থ্রো করেছিলেন। তার দর্শনীয় থ্রোতে রান আউট হয়েছিলেন ইনজামাম -উল -হক। ব্যাকয়ার্ড পয়েন্টে সেরা ফিল্ডার তিনি, অসাধারণ ডাইভ আর দারুন ফিল্ডিং দক্ষতায় এটা নিজের দখলে নিয়েছিলেন জন্টি।
বিশ্বকাপের ১৮ মাস পরে গড়েন অনন্য কৃর্তি। এক ম্যাচে নেন পাঁচটি ক্যাচ, যা একজন ফিল্ডার হিসেবে বিশ্ব রেকর্ড।
এক ম্যাচে পাঁচটি ক্যাচ নেওয়া একজন উইকেটরক্ষক জন্য কাজটা সহজ। কিন্তু একজন ফিল্ডাররের জন্য সেটা কষ্টসাধ্য এবং দুরহ ব্যাপার। সেই অরাধ্য কাজকে বাস্তবে রুপ দিয়েছিলেন জন্টি রোডস। ১৯৯৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিপক্ষে পাঁচটি ক্যাচ নিয়ে বিরল এক রেকর্ডের জন্ম দেন রোডস। স্লিপ ফিল্ডাররা এর আগে তিন-চারটা ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ড ছিল। তিনি এসব ছাড়িয়ে গেছেন। সবচেয়ে বেশি ক্যাচ নেওয়ার রেকর্ডটিতে নিজের নাম লিখিয়েছেন।
জন্টি রোডস সেই রেকর্ডের সুচনা হয়েছিলে ব্রায়ান লারাকে দিয়ে। লারা পুল শট খেলেছিলে। বল ব্যাটে ঠিকমত সংযোগ না হওয়াতে বলটি স্কোয়ার লেগ থেকে প্রায় পাঁচ গজ দূরে বাতাসে উড়ে। ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়ানো জন্টি ক্যাচটি নিতে সবেগে দৌড় শুরু করেন। দুরন্ত এক ডাইভে সেদিন ক্যাচটি তালুবন্দি করেছিলেন। যা এক কথায় অবিশ্বাস্য ছিল।
পরের ক্যাচটা ছিল আরো বেশি দর্শনীয়। যা তালুবন্দি করা ছিল এক কথায় অসম্ভবও। শর্ট মিড উইকেটে সেই ক্যাচটি নিয়েছিলেন রোডস। ভয়ে ভয়ে তা দেখছিলেন ফিল সিমন্স। দারুণ এক ডাইভে তা এক হাতে লুফে নিয়েছিলেন তিনি। জিমি আডামস মিডউইকেটে রোডসের হাতে ক্যাচ তুলে দেন, তা নিতে তেমন বেগ পেতে হয়নি তাঁকে।
আন্ডারসন কামিন্স কাট শট খেলেছিলেন আলান ডোনাল্ডের বলে। বলটি থার্ডম্যানের কাছাকাছি উড়ে যাচ্ছিল। ক্যাচটি তালুবন্দি করতে রোডস আকাশাভিমুখে ঝাপ দেন, বলটি তালুবন্দি করেই ক্ষান্ত হন। ওপেনার ডেসমন্ড হায়ন্সের ক্যাচ নিয়ে এক ম্যাচে পাঁচ ক্যাচের বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। মন মুগ্ধকর ফিল্ডিং আর বিরল রেকর্ডের দিনে ম্যাচ সেরা নির্বাচিত হয়েছিলেন জন্টি।
ক্যাচ নেওয়ার উপর ভিত্তিতে ম্যাচ সেরা হওয়া একমাত্র ক্রিকেটার জন্টি রোডস। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বদলি হিসাবে ফিল্ডিং করতে নেমে সাতটি ক্যাচ নেন রোডস। সাত ক্যাচেই তাঁকে এনে দিয়েছিল ম্যাচ সেরার পুরস্কার।
জন্টি ফিল্ডিংয়ে দুরন্ত দূর্বার হওয়ার পিছনে ছিল কঠোর পরিশ্রম। দলের অন্য যেকোনো ক্রিকেটারের চেয়ে বেশি কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। প্রায়শই টিম বাস ছাড়তে দেরি হত তাঁর জন্য, সব সময় অতিরিক্ত এক রাউন্ড ফিল্ডিং অনুশীলন করতেন। দশ মিটার বা তার চেয়ে কম দূরত্বে রিফ্লেক্স ক্যাচ অনুশীলন করতেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যাকয়ার্ড পয়েন্টে তাঁর চেয়ে ভাল ফিল্ডিং কেউ করতে পারেনি। যেখানে তিনি চিতার মত লাফিয়ে পড়তেন, ভারসাম্য রেখে বল ছুড়তেন, সহজে সিঙ্গেলস নেওয়া বন্ধ করে দিতে পারতেন বলে খ্যাতি অর্জন আছে।
তিনি ব্যাটিংয়ের জন্যও ততটা কঠোর পরিশ্রম করতেন। যতটা পরিশ্রম প্রয়োজন ছিল। নিজেকে ভালভাবে তৈরি করার জন্য ব্যাটিং ট্যাকনিকটাই পুরোপুরি বদলে ফেলেছিলেন। তাঁর পরিবর্তন কাজে দিয়েছিল বেশ। ফলে ওয়ানডে এবং টেস্ট ব্যাটিং গড় পঞ্চাশে চলে যায়। ফিল্ডিংয়ে দুরন্ত এই ক্রিকেটার ব্যাটিংয়ে রিভার্স শটের অন্যতম জনক।
তিনি যে শুধু ফিল্ডিংয়ে পারদর্শী ছিলেন এমন কিন্তু নয়, ব্যাট হাতেও দারুন সফল ছিলেন। ১৯৯২ সালে তাঁর টেস্ট অভিষেক হয়েছিল। ভারতে বিপক্ষে দারুন একটা শুরু হয়েছিল বলা যায়; নিজ মাঠে সেদিন প্রথম ইনিংসে রান করেছিলেন ৪২, দ্বিতীয় ইনিংসে ছিলেন ২৬ রানে অপরাজিত। টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরির দেখা পান ১৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে; ১০১ রানের অপরাজিত ইনিংস ম্যাচটি ড্র করতে সাহায্য করেছিল দক্ষিন আফ্রিকাকে। তিন সেই টেস্ট সিরিজ ১-০ জিতেছিল প্রোটিয়ারা।
২০০১ সালে ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণ থেকে অবসরে যান রোডস। দক্ষিন আফ্রিকার হয়ে ৫২ টেস্টে ৩৫.৬৬ গড়ে রান করেছেন ২৫৩২ রান। তিন সেঞ্চুরির সাথে সতেরো ফিফটি আছে তাঁর নামের পাশে। ফিল্ডার রোডসের নামের পাশে আছে ৩৪টি ক্যাচ।
টেস্ট ক্রিকেট ছাড়লেও তখন ওয়ানডে খেলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন; বিদায়ের মঞ্চ হিসেবে ঠিক করে রেখেছিলেন ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বাকাপ থেকেই বিদায় নিতে চেয়েছিলেন রোডস, নিয়তির কী পরিহাস সেই সুযোগটাও পেলেণ কই!
তার আগে কেনিয়ার বিপক্ষে শুন্যে ক্যাচ ধরতে গিয়ে হাত ভেঙ্গে যায়, ফলে বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার আগে অবসরে যেতে হয় তাঁকে। দল থেকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে নেন রোডস, তাঁর জায়গায় সুযোগ পান গ্রায়েম স্মিথ।
দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ২৪৫টি ওয়ানডে ম্যাচে ৫৯৩৫ রান করেছিলেন রোডস। পঁয়ত্রিশ ফিফটির পাশাপাশি আছে ২টি সেঞ্চুরি। বিশ্ব ক্রিকেটের এই সেরা ফিল্ডার হাতে তালুবন্দি হয়েছে ১০৫টি ক্যাচ।
রোডসই প্রথম ক্রিকেটার ছিলেন, যিনি পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ের জন্মের সময় তিনি এই ছুটি নিয়েছিলেন। যা ছিল সেমি রিটায়ার্ডের মত।
মজার ব্যাপার হল ক্রিকেটের এই বাজপাখি হকি খেলাও পা্রদর্শী ছিলেন। শুধুই হকি খেলতেন তা কিন্তু নয়। তাঁর হকি খেলার স্কিল এমন ছিল যার জন্য ১৯৯৬ সালে অলিম্পিক গেমসে দক্ষিণ আফ্রিকার হকি দলে সুযোগ পান। হ্যামাস্ট্রিং ইনজুরির কারণে সেই অলিম্পিক অংশ নিতে পারেননি রোডস। হকি দলে গোলকিপার বলেন আর যেকোনো পজিশনে খেলে থাকেন না কেন। এটা তাঁর ক্রিকেটে ফিল্ডিংয়ে দারুন কাজে দিয়েছিল।
মাঠের ক্রিকেট ছাড়ার পর স্ট্যান্ডার্ট ব্যাংকে নির্বাহী হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যাংক ক্রিকেট সম্প্রচারসত্বে সাথে জড়িত ছিলেন।
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় ক্রিকেট দলের ফিল্ডিং কোচের দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও, আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দলের ফিল্ডিং কোচ হিসেবে করেছেন। কেনিয়া ক্রিকেট দলও রোডসকে দলের সহকারী কোচের জন্য চুক্তিবদ্ধ করেছিল যা ২০১১ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপ পর্যন্ত কার্যকরী ছিল। সে সময়ে তিনি কেনিয়ার ফিল্ডিং ও ব্যাটিংয়ে সহায়তা করেছিলেন। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে দক্ষিণ আফ্রিকান পর্যটন কর্তৃপক্ষ তাকে ভারতে তাদের ব্র্যান্ড এম্বাসেডর নিযুক্ত করেছিল। বর্তমানে তিনি সুইডেন ক্রিকেট দলের কোচের দায়িত্বে আছেন।
১৯৯৯ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটারের সম্মাননা লাভ করেন। ২০০৪ সালে এসবিএস ৩-এর গ্রেট সাউথ আফ্রিকান টেলিভিশন সিরিজে ভোটের মাধ্যমে সেরা ১০০ দক্ষিণ আফ্রিকানদের তালিকায় ২৯তম অবস্থানে ছিলেন।