সুরিয়ার ‘সূর্য’ হয়ে ফেরা!

অস্তমিত সূর্যের মতো শেষ আভায় মিলিয়ে যেতে বসেছিলেন সুরিয়াকুমার যাদব। ব্যাটিং ব্যর্থতার বৃত্তে বন্দী হলেন। আর সেই বন্দী দশাতেই ‘ফর্ম’ নামক বলয় থেকে কক্ষচ্যূত হয়ে পড়েছিলেন। সুরিয়া আবারো সূর্যের মতো জ্বলে উঠতে পারবেন কিনা— এমন উদ্ভুত প্রশ্নে বাড়তে শুরু করলো শঙ্কা, সংশয়। সমর্থকদের মধ্যে সেই সংশয় মিশ্রিত সম্ভাব্যতার গল্পও লেখা শুরু হয়ে গেল তাঁকে নিয়ে।

কিন্তু অস্তকালেও যে সূর্য মেঘের বুক চিরে একমুঠো রোদ বিলিয়ে যেতে চায়। সুরিয়াকুমার যাদবও ঠিক এভাবেই আবারো স্বরূপে ফিরলেন। আবারো ব্যাট হাতে সূর্যের মতো জ্বলে উঠলেন। বুঝিয়ে দিতে চাইলেন, এ সূর্য অস্তমিত হওয়ার নয়।

এ সূর্যের আবর্তন শুধুই উদ্ভাসিত রূপ পরিস্ফূটন ঘটানোর দিকে। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের নীল জার্সি গায়ে সেই উদ্ভাসিত রূপেই ফিরলেন সুরিয়াকুমার যাদব। পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে দুর্দান্ত এক ফিফটিতে আবারো পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে রাঙালেন এ ব্যাটার।

১৭ মার্চ, ২০২৩। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ। সুরিয়াকুমার যাদব ফিরলেন প্রথম বলেই, শূন্য রানে। টি-টোয়েন্টির নাম্বার ওয়ান ব্যাটারের এমন ব্যর্থতাকে সাময়িক ভেবে তা দৃষ্টিগোচরের বাইরেই রাখা হলো। কিন্তু চরমভাবে দৃষ্টিকটু হয়ে গেল ব্যাপারটা, যখন দেখা গেল, সুরিয়া পরের দুই ম্যাচেও সেই শূন্য রানে ফিরলেন, একই সাথে প্রথম বলে।

অর্থাৎ টানা তিন ম্যাচে গোল্ডেন ডাক! একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন বিব্রতকর রেকর্ডের পাশে এতদিন যেখানে কোনো নামই ছিল না। সুরিয়ার হাত ধরে সেই বিব্রতকর রেকর্ডেরই দ্বার উন্মোচিত হলো।

সুরিয়ার ‘শূন্য’র সেখানেই শেষ নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পূর্ণ উদ্যমে আইপিএলের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু দুই ম্যাচ বাদে সেখানেও আবারো শূন্যে কাঁটা পড়লেন। এবারও সেই প্রথম বলেই। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে চার চারবার গোল্ডেন ডাক!

দিল্লী ক্যাপিটালসের বিপক্ষে সেই ডাকের পর যদিও পরের ম্যাচে ৪৩ রান করে কিছুটা ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতার বিপক্ষে সে ম্যাচে সুরিয়ার ব্যাটে ছিল না কোনো আত্মবিশ্বাসের ছাপ। টানা ব্যাটিং ব্যর্থতায় নিজের শট সিলেকশনেও যেন সেই পুরনো আগ্রাসনের দেখা মিলছিল না। কিন্তু পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে যেন নিজের পুরনো রূপকেই নতুন মোড়কে এনে সবাইকে দেখালেন সুরিয়াকুমার যাদব। খেললেন ২৬ বলে ৫৭ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস।

আর এই ইনিংস দিয়েই নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছেন সুরিয়াকুমার যাদব। আইপিএল ক্যারিয়ারে নিজের দ্রুততম অর্ধশতক পেলেন এই ইনিংস দিয়েই। ৫৭ রানের ইনিংস খেলার পথে এ ব্যাটার ব্যক্তিগত পঞ্চাশ রান পূরণ করেন ২৩ বলে।

এখানেই শেষ নয়। ছুঁয়েছেন একটি মাইলফলকও। এই ম্যাচেই টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ৬০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সুরিয়াকুমার যাদব। আর এখানেই গড়েছেন নতুন এক রেকর্ড। সুরিয়া তাঁর টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ৬০০০ রান টপকেছেন ৪০১৭ বলে। যা ভারতীয় ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম বলে ৬০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করার নতুন রেকর্ড। এর আগের এ রেকর্ডটি ছিল সুরেশ রায়নার। তিনি ৬০০০ রান পূরণ করেছিলেন ৪২৯৫ বলে।

অবশ্য দুর্দান্ত এ ইনিংস দিয়ে নিজের ফেরার দিনে শেষ পর্যন্ত মুম্বাইকে ম্যাচ জেতাতে পারেননি সুরিয়াকুমার যাদব। ১৮ তম ওভার পর্যন্ত মুম্বাইকে কক্ষপথেই রেখেছিলেন এ ব্যাটার। কিন্তু ঐ ওভারেই সুরিয়া আউট হতেই মুম্বাইয়ের জয়ের পথ বেঁকে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৩ রানে হারতে হয় মুম্বাইকে।

তবে মুম্বাইয়ের পরাজয়ের দিনেও স্বস্তির ব্যাপার হলো, সুরিয়ার স্বরূপে ফেরা। বহুদিন ধরে রানখরায় থাকা এ ব্যাটারকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে কিছুটা পেয়েই বসেছিল বটে। কিন্তু সেখান থেকে পরিত্রাণের রাস্তাটা তিনিই অবশেষে তৈরি করেছেন। ব্যাট হাতে এ দিন শুরু থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিং করেছেন সুরিয়া।

পাঞ্জাবের বোলারদের মনে ভীতি তৈরি করতে খেলেছেন নিজের প্রায় সব শট। নিজের ট্রেডমার্ক শট সুইপে ছিলেন সাবলীল। ফ্লিকে ছিলেন আগের মতোই দুর্দান্ত। আর এমন আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতেই ফিরে পেয়েছেন নিজেকে।

চার ছক্কার মিশেলে দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের আগ্রাসনে দারুণ এক কামব্যাক। সুরিয়ার মতো ব্যাটারদের বুঝি এভাবেই ফিরে আসতে হয়। তবে সুরিয়াকুমার যাদব নিজেও হয়তো এমন কামব্যাকের গল্প না লিখে ধারাবাহিকতার এক কাব্য লিখতে চাইবেন। সুরিয়াকুমার যাদবের ব্যাট হাতে সূর্যের মতো জ্বলে ওঠার রূপ হয়তো বোলারদের অস্বস্তিতে ফেলবে, কিন্তু সেই জ্বলন্ত ব্যাপারটাই শীতলতার পরশে স্বস্তিতে ভাসাবে সমর্থকদের।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link