এ যেন ক্রিকেট মাঠে এক ফুটবল কোচের আবির্ভাব। এবারের আইপিএলে গুজরাট টাইটান্সের ডাগআউটে ঠিক এমন কিছুরই দৃশ্যায়ন হয়েছে। গুজরাটের ম্যাচ মানেই কোচ আশিস নেহারার ভাবনার রাজ্যজুড়ে ব্যস্ততা, চিন্তনীয় ভঙ্গিমা, ডাগ আউটে অদ্ভুত ধরনের অস্থিরতা। যেন কোনো এক সকার কোচ এসে গোটা একটা ক্রিকেট ম্যাচের গতিবিধি নিজের দলের দিকে আনার লড়াইয়ে নেমেছেন।
সেই লড়াইয়ের সিংহভাগই বিজয়ীর বেশে মাঠ ছেড়েছেন আশিস নেহরা। কিন্তু সফল এ কোচ তীরে এসে তরী ডোবালেন ফাইনাল ম্যাচে এসে। গুজরাট টাইটান্স তখন টানা দুই শিরোপা জয়ের দ্বারপ্রান্তে। শেষ ওভারে চেন্নাইয়ের সামনে ১৩ রানের সমীকরণে মোহিত শর্মা প্রথম ৪ টা বলেই মারেন ইয়র্কার। আর ঐ চার বলে স্কোরকার্ডে মাত্র ৩ টি রান যোগ করে চেন্নাই।
ফলত, চেন্নাইয়ের সামনে তখন শেষ ২ বলে ১০ রানের প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠা সমীকরণ। এমতাবস্থায় কোচ আশিস নেহরা একাদশের বাইরে থাকা এক ক্রিকেটারকে মাঠে পাঠান। মূলত, ঐ সময় নেহরা কিছু বার্তা পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মোহিত শর্মা ড্রিংকস নেওয়ার পরেই ছন্দ হারান। পরের দুই বলে লাইন মিস করেন। আর সেই দুই বলে একটি ছয় ও একটি চার মেরে অবিশ্বাস্যভাবে চেন্নাইকে ম্যাচ জেতান রবীন্দ্র জাদেজা।
ওভার চলাকালীন কোচের এমন অতি বিচক্ষণতার খেসারত গুজরাটকে দিতে হলো কিনা, তা নিয়ে এরপর থেকেই বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ম্যাচ পরবর্তী অনুষ্ঠানে সাবেক ক্রিকেটার, জনপ্রিয় ক্রিকেট বিশ্লেষক সঞ্জয় মাঞ্জেরেকার মূলত ম্যাচের ঐ মুহূর্তের কথাই টেনে আনেন।
তিনি বলেন, ‘তিনটা দুর্দান্ত ইয়র্কার। এই সময়ে মাঠে ড্রিংকস নিয়ে আসা হলো। যখন আবার সে বোলিং প্রান্তে যাচ্ছিল, মোহিতকে কিন্তু শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী লাগছিল। কেন শুধু শুধু ছন্দটা নষ্ট করা হলো? ধোনি হলে উইকেটের পেছন থেকে কিছু করত না, বোলারকে তার মতো বল করতে দিত। বলছি না, তারা এই কারণেই হেরেছে। তবে আমার মনে হয় না এটা ভালো কৌশল ছিল।’
সঞ্জয় মাঞ্জেরেকারের মতো আরেক আলোচক টম মুডিও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘ঐ ওভারের মধ্যেই ড্রিংকস আনা লাগলো? ও তো ভালই করছিল। এমন কী হয়েছিল সেখানে। আমার মনে হয় না, এটা দারুণ কোনো ট্যাক্টিকস ছিল।’
ভারতের আরেক সাবেক ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কারেরও একই মত। তাঁর মতে, ‘মোহিত দারুণ বল করছিল। ওভারের মাঝে এমন ব্রেক দরকার ছিল না আসলে। একজন বোলার যখন ছন্দে থাকে, তখন নতুন করে তাঁকে পরামর্শ দেওয়া উচিৎ না। তাঁরা যেটা করেছে, সেটা কোনো দিক দিয়েই উত্তম সিদ্ধান্ত ছিল না।’
আশিস নেহরার এমন কৌশলগত সিদ্ধান্তের নমুনা কিন্তু এটাই প্রথম নয়। প্রায় প্রতি ম্যাচের বেশিরভাগ সময়েই তিনি খেলোয়াড়দের পরামর্শ দিতে ব্যস্ত থাকেন। বাউন্ডারি লাইনের কাছেই তাঁকে সর্বদা ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। এমনকি ফিল্ডিং প্লেসমেন্টের ব্যাপারেও তাঁকে অধিনায়কের সাথে সলা পরামর্শ করতে দেখা যায় প্রায়শই। একদম একজন ফুটবল কোচের মতো।
একজন ফুটবল কোচ যেমন তাঁর ফরমেশন অনুযায়ী খেলোয়াড়দের সব সময় পরামর্শ, দিক নির্দেশনা দিয়ে ব্যস্ত রাখেন, আশিস নেহরাও ঠিক তেমনটাই করেন। বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ক্রিকেটারদের সাথে ম্যাচ চলাকালীনও একটা যোগসূত্র স্থাপন করা চেষ্টা করেন।
আশিস নেহরার এমন রণকৌশলে দিল্লী ক্যাপিটালসের অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার তো প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘ওনাকে আমার একজন সকার কোচের মতোই মনে হয়। এটা নতুন। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এমন কোচকেই যেকোনো দলের প্রয়োজন।’
আশিস নেহরার এমন কোচিংয়ে গুজরাট টানা দুই আসরে সফল হলেও তাঁর এমন অ্যাপ্রোচ নিয়ে সমালোচনাও কম হয় না। ভারতের সাবেক ওপেনার, নেহরার এক সময়কার সতীর্থ বিরেন্দ্র শেবাগ যেমন নেহরার কোচিং কৌশল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, ‘নেহরা সব সময় খেলোয়াড়দের পরামর্শ দেয়। যেটা এক দিক দিয়ে ভাল। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই এটা নির্দিষ্ট ক্রিকেটারের উপর একটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। মনঃসংযোগে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। আর এমন চাপের মাঝে পারফর্ম করাও কঠিন হয়ে যায়। কেউ যদি দারুণ ছন্দে থাকে, তাঁকে আদৌ কি কোনো পরামর্শ দেওয়ার প্রয়োজন আছে? আমার তো মনে হয় না, কোনো প্রয়োজন আছে।’
যদিও এই আশিস নেহরার অধীনেই গুজরাট টাইটান্স টানা দুইবার ফাইনাল খেললো। অর্থাৎ তাঁর কোচিং নিয়ে যতোই সমালোচনা হোক, তিনি ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সেরার ঠিকই বের করে আনতে পারেন। এমনিতে কোচ হিসেবে আশিস নেহরা গতবারেই আইপিএলের এক অনন্য ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছিলেন।
গতবার রাজস্থান রয়্যালসকে হারিয়ে আইপিএল শিরোপা জিতেছিল গুজরাট টাইটান্স। আর ঐ শিরোপার মাধ্যমেই আইপিএলের প্রথম কোনো দলকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন ভারতীয় একজন কোচ। আইপিএলের ১৬ বছরের ইতিহাসে আশিস নেহরাই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ভারতীয় কোচ, যিনি আইপিএল শিরোপা জিতেছেন।
একই সঙ্গে ভারতের সাবেক এই পেসার আরও একটি বিরল রেকর্ডে নিজের নাম লিখিয়েছিলে। রিকি পন্টিং, লেম্যান আর শেন ওয়ার্নের পর খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে দুই ভূমিকাতেই আইপিএলের শিরোপার কীর্তি রয়েছে তাঁর। ২০১৬ সালের আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে খেলোয়াড় হিসেবে আইপিএল শিরোপা জিতেছিলেন তিনি। এর ৬ বছর পর, ২০২২ সালে কোচ হিসেবে গুজরাট টাইটান্সকে শিরোপা জেতান তিনি।
শিরোপা জিততে পারতেন এবারও। তবে শেষ মুহূর্তে নিজের রণকৌশলই শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে ১৬ বছরের ইতিহাসে বিদেশি কোচদের ভিড়ে এত দিন ধরে কোনো ভারতীয় সাবেকের নাম না থাকাটা বেশ আক্ষেপই ছড়িয়েছে আইপিএলে। আশিস নেহরা সেই আক্ষেপ ঘুচিয়েছেন। বিদেশি কোচদের সাথে পাল্লা দিয়ে তিনি তাঁর দলকে সাফল্যের রসদ জুগিয়েছেন ধারাবাহিকভাবে। টানা দুইবার ফাইনালে তোলাটাই, তার প্রমাণ।
এর চেয়েও বড় কথা, আশিস নেহরা তাঁর কোচিংয়ে একটা স্বতন্ত্র পন্থা মেনে চলেন। তাঁর কোচিংয়ে মধ্যে একটা নিজস্বতা আছে। আর এ কারণেই এত গুলো বছর পর আইপিএলের মঞ্চে কোনো ভারতীয় কোচকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
নতুন একটা ফ্রাঞ্চাইজির দায়িত্ব পেয়েই টানা দুই আসরে ফাইনালে তোলা, আর যাইহোক চাট্টিখানি কোনো কথা নয়। আশিস নেহরা সেই কাজটিই করে দেখিয়েছেন দুর্দান্তভাবে। আর তাঁর দুর্দান্ত যাত্রায় দুরন্ত গতিতে এগিয়েছে গুজরাট টাইটান্সও।