‘সিনিয়র হটাও, বাংলাদেশের ক্রিকেট বাঁচাও’ — এমন একটা নীতি মেনেই যেন এগিয়ে চলেছেন প্রধান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে। তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রাণ ফিরছে নাকি অস্বস্তিদায়ক, ঘোলাটে পরিবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে, সেটি ভিন্ন আলাপ। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে লঙ্কান এ কোচের প্রভাব সুস্পষ্টই বটে।
একটু পিছনে ফেরা যাক। ২০১৭ সালের কথা। বাংলাদেশ তখন নিজেদের ইতিহাসের শততম টেস্ট খেলার দ্বারপ্রান্তে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সে টেস্ট নিয়ে তখন এমনিতেই গণমাধ্যমে আলোচনার স্রোত। তবে সব কিছু পাশ কাটিয়ে যেন প্রধান খবর হয়ে উঠলো, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ সে টেস্ট ম্যাচের দল থেকে বাদ পড়েছেন! ধারণা করা হয়, রিয়াদকে লাল বলের ক্রিকেট থেকে সরানোর নেপথ্যে ছিল তৎকালীন কোচ হাতুরুসিংহেই।
লঙ্কান এ কোচ অবশ্য পরের বছরেই কোচের দায়িত্ব ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন নিজ দেশ শ্রীলঙ্কায়। হাতুরুর প্রস্থানের পর রিয়াদেরও টেস্ট দলে প্রত্যাবর্তন ঘটে দ্রুতই। তবে দ্বিতীয় মেয়াদে যখন আবার হাতুরুসিংহে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিলেন, ঠিক তার দুটি সিরিজ পরেই বাদ পড়ে যান রিয়াদ। অতি নাটকীয় কিছু না হলে, আসন্ন ওয়ানডে বিশ্বকাপে রিয়াদের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনাও বেশ ক্ষীণ।
ঐতিহাসিক শততম টেস্টে জয়টা পেয়েছিল বাংলাদেশই। আর সে ম্যাচজয়ের নায়ক ছিল তামিম ইকবাল। হাতুরুর অধীনে রিয়াদ দল থেকে বাদ পড়েছেন। তামিম কখনোই বাদ পড়েননি। কিন্তু, সবাইকে চমকে দিয়ে নিজে থেকেই সরে গিয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন ধরেই ফর্মহীনতায় ছিলেন। সাথে ফিটনেস ইস্যু তো ছিলই। তবে কোচ হাতুরু নিজেও হয়তো তামিমকে নিয়েই বিশ্বকাপের রণকৌশল সাজাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু সেটা হয়নি। কেন হয়নি, তার উত্তরটা এখন বেশ খানিকটা ধোঁয়াশার ভিতরেই আছে। তবে বাতাসে গুঞ্জন, ফিটনেস ইস্যু নিয়ে কোচ আর অধিনায়কের কিছুটা ইগোর লড়াই-ই হয়েছিল। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন তো নিজেই প্রকাশ্যে বলেছেন, ফিট না থাকা সত্ত্বেও তামিমের জোর করে খেলা নিয়ে হাতুরু চরম ক্ষিপ্ত ছিলেন। আর ক্ষিপ্ততা কিংবা অভিযোগ গিয়েছে স্বয়ং বিসিবি সভাপতির কাছেও।
তামিমের বিদায় নিতে চাওয়ার পিছনে হাতুরুর হয়তো মূখ্য ভূমিকা নেই। পারিপার্শ্বিক অনেক অজানা চাপেই হয়তো তামিম থেমেছিলেন। তামিম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধি ফিরলেও ড্রেসিংরুমে হাতুরুসিংহে যে রীতিমত প্রভাব বিস্তার করেন তা এখন প্রমাণিতই বটে।
লঙ্কান এ কোচের এমন আধিপত্যের আভাস মিলেছিল নতুন মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই। এর আগের মেয়াদে মুশফিকুর রহিমের সাথেও ছিল শীতল সম্পর্কের গুঞ্জন। তিনি যে কড়া হেডমাস্টার তা আরো একবার বুঝিয়ে দেন দ্বিতীয় মেয়াদেও।
এই কয়েক মাস আগেও অফ ফর্মের কারণে হাতুরুর চক্ষুশূল হতে বসেছিলেন মুশফিক। ঘরের মাটিতে আইরিশদের বিপক্ষে সিরিজই ছিল তাঁর লাইফ লাইন। হাতুরুসিংহে ঐ সিরিজ দিয়েই মুশফিককে ৬ নম্বরে খেলানো শুরু করেন। আর তাঁর জায়গায় নিয়ে আসেন নবাগত তাওহিদ হৃদয়কে। হাতুরুর সেই এক্সপেরিমেন্টের দারুণ ফলও পেয়েছে বাংলাদেশ। মুশফিকও চেনা ছন্দে ফিরতে শুরু করে। আর হৃদয়ও দেন আস্থার প্রতিদান।
সব ফরম্যাটে অধিনায়ক এখন সাকিব। দ্বিতীয় মেয়াদে এসে এই সাকিবের সাথেই দল নিয়ে বেশি আলাপচারিতার দৃশ্যে দেখা গেছে হাতুরুকে। কে জানে, হয়তো আগামী বিশ্বকাপে সাকিবকেই নেতৃত্বে দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। তামিম অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ায়, হাতুরুর ইচ্ছাপূরণ হয়েছে। সাকিবকেই তাঁর দলের অধিনায়ক হিসেবে আসন্ন বিশ্বকাপে পেতে যাচ্ছেন।
হাতুরুর আগমনে প্রথমে রিয়াদের বাদ পড়া। এরপর তামিমের স্বেচ্ছায় প্রস্থান ও বাইরের চাপে প্রত্যাবতর্ন। মুশফিকের জায়গা বদল। হয়তো এ সব কিছুর নেপথ্যে আরো অনেক ফ্যাক্টর আছে। তবে এটা এক প্রকার প্রমাণিতই যে, হাতুরুর উপস্থিতিতে বেশ প্রভাবিত হয় বাংলাদেশ দল, প্রভাবিত হয় বোর্ডও। এটাই বুঝি হাতুরু ফ্যাক্টর। না হলে শেষ কবেই বা কোনো বিদেশি কোচকে এভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে দেখা গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট? সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।