প্রথম ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে দশ উইকেটে হার, ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে ধরাশায়ী – এরপরও পাকিস্তান ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে শিরোপা জিতেছিল।
অধিনায়কত্বের দর্শন বুঝতে পাকিস্তানের এই শিরোপা জয়ের গল্পটাই যথেষ্ট; ভাঙাচোরা একটা দলকে জাগিয়ে তোলাই বোধহয় অধিনায়কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ঠিক সময়ে সেটা করতে পেরেছেন বলেই ট্রফি ধরা দিয়েছে ইমরান খানের হাতে।
যুগে যুগে সব অধিনায়কই ইমরান খানের মত আলোর দিশারি হতে চেয়েছেন, চেয়েছেন সতীর্থদের সেরাটা বের করে আনতে। চেষ্টাটা যেভাবেই হোক, চাওয়াটা সবারই এক ছিল। মাশরাফি বিন মর্তুজাও উজ্জীবিত করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন পুরো দলকে।
তাঁর অস্ত্র ছিল দলকে এক করে রাখার ক্ষমতা। আজকাল যেটাকে ‘তুই পারবি’ বলে লোকে ট্রলও করে। এই যে অধিনায়কের নি:শর্ত ভরসা সেটা পেয়েই জ্বলে উঠেছিল পথ হারানো বাংলাদেশ।
২০১৪ সালের কথা, জিততেই ভুলে গিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। হারতে হারতে আত্মবিশ্বাস এতটা তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল যে আফগানিস্তান, হংকংয়ের মত দলের কাছেও জয় পায়নি টাইগাররা।
ভারতের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারির দলের বিপক্ষে ১০৫ রান তাড়া করতে নেমে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছিল ব্যাটাররা। অথচ মাশরাফি নেতৃত্বের চেয়ার ফিরতেই এলোমেলো দলটা ফিরেছিল স্বরূপে; কাপ্তানের বিশ্বাসের হাত কাঁধের উপর পেয়েই এক হয়েছিল পুরো দল।
অথচ নবাগত সুশীল ক্রিকেট ভক্তরা এখন ট্রল করেন ‘তুই পারবি’ নিয়ে; ব্যঙ্গ করেন মাশরাফি বিন মর্তুজার অধিনায়কত্বকে। ২০১৪ সাল আর ২০১৫ সালের দল তো প্রায় একই ছিল, তবু ফলাফলে এত ফারাক কেন – সেটার উত্তর জানা সত্ত্বেও এড়িয়ে যান তাঁরা; যেন ম্যাশের প্রশংসা করলেই গায়ে ফোসকা পড়বে।
মাশরাফি মর্তুজাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করা হয় ২০১৯ বিশ্বকাপ ইস্যুতে। সত্যি বলতে, ম্যাশের সবচেয়ে বড় ভক্তও নির্দ্বিধায় মানতে পারবে যে তাঁর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ মিশন ফ্লপ ছিল; কিন্তু নিন্দুকেরা মানতে চান না, ২০১৯ বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত অধিনায়ক কিংবা খেলোয়াড় মাশরাফিকে নিয়ে কখনো এক বিন্দু সংশয় ছিল না।
এমনকি বিশ্বকাপের আগের ত্রিদেশীয় সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলার ছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। কিন্তু একটা বিশ্বকাপে প্রত্যাশা মেটাতে না পারায় সেসব অস্বীকার করতে চায় অনেকে, অস্বীকার করতে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অধ্যায়গুলোর একটিকে।
কেউ কেউ তো আরেক কাঠি সরস, প্রশ্ন তোলেন মাশরাফি মর্তুজার ক্যারিয়ারের অর্জন নিয়েও। অথচ দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের মত লেখক বই লিখেছেন তাঁকে নিয়ে, অর্জন না থাকলে নিশ্চয়ই পাঁচশো পৃষ্ঠার বই হতো না, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তো আর নিজের কল্পনাপ্রসূত কিছু লেখেননি মুখোপাধ্যায় সাহেব।
এমন লোকের অভাব নেই আজকাল যারা এই বইটাকেও মাশরাফিকে ‘গ্রেট’ বানানোর একটা অপচেষ্টা ভাবেন! অথচ, কোনো তর্ক ছাড়াই তো মাশরাফি বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। পরিসংখ্যান সেই কথাই বলে। অধিনায়কত্ব বাদ দেন, মাশরাফি এখনও ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী। এখনও তাঁর টেস্ট উইকেটসংখ্যার ধারের কাছেও নেই বাংলাদেশের কোনো পেসার।
মাশরাফি নামক বই কিংবা মানুষটা – পড়লেই ঝিমিয়ে পড়া আত্মা জেগে ওঠার শক্তি পায়; কিছু একটা করে দেখাতে হাত নিশপিশ করে। বিশ্ব ক্রিকেটে হয়তো ম্যাশ একটা অংশ মাত্র, বাংলাদেশের আকাশে তিনি কিন্তু নক্ষত্রের চেয়ে উজ্জ্বল।
মাশরাফি মর্তুজার অধিনায়কত্ব নিয়ে একটু বেশিই আলোচনা হওয়ায় ঢাকা পড়েছে তাঁর পারফর্মার সত্তা। এখন পর্যন্ত পেসারদের মাঝে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক উইকেট আছে এই ডানহাতির ঝুলিতেই।
টেস্ট, ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই দেশসেরা উইকেটশিকারী পেসার তিনি। ভবিষ্যতে হয়তো তাসকিন, ফিজরা তাঁকে ছাড়িয়ে যাবেন; মজার ব্যাপার, এই তরুণদের কাছে যদি জানতে চাওয়া হয় তাঁদের পথটা দেখিয়েছেন কে, তারা এক শব্দে বলবে ‘ম্যাশ’।
সাকিব আল হাসানের মত ক্রিকেটীয়-মস্তিষ্ক নেই, তামিম ইকবালের মত গুছানো দল পাননি, তবু চর্ম চোখ কিংবা সংখ্যাতত্ত্বে মাশরাফি মর্তুজা বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক। ম্যাশকে সেই স্বীকৃতি দিতে না চাইলে লজ্জা পাবে স্বয়ং বাংলাদেশ ক্রিকেট।
মাশরাফির সমালোচনা অবশ্যই হতে পারে। ২০১৯ বিশ্বকাপে তাঁর ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। প্রশ্ন তোলা যায় – কেন সেই বিশ্বকাপে তাঁর টিম ম্যানেজমেন্টের কোনো প্ল্যান ‘বি’ ছিল না? কিন্তু, তারপরও তাঁর গোটা ক্যারিয়ারের গ্রেটনেস সেখানে ম্লান হয় না।