সালটা ২০১৫, লিকলিকে এক তরুণ করলেন বাজিমাত। ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচেই ফাইফার। বিশ্বজুড়ে একটা সোরগোল পড়ে গেল। তাকে নিয়ে কাটাছেড়া হল। তার বোলিং অ্যাকশন নিয়ে বিস্তর পর্যালোচনা। পরবর্তী সময়ে মুস্তাফিজুর রহমান বনে গেলেন বাংলাদেশের পেস আক্রমণের একমাত্র সম্বল।
পেসার শূন্য বাংলাদেশ থেকেছে তা নয়। তবে পেসারদের দিয়ে পরিপূর্ণ ছিল না কখনোই। একই সময়ে দলের সব ফাস্ট বোলাররাই পারফরম করেছেন তেমন চিত্র নেই বললেই চলে। রীতিমত লাইন ধরে একজন একজন করে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পারফরম করতেন বাংলাদেশের পেসাররা।
আধিপত্য থাকত স্পিনারদের। প্রতিপক্ষের সমস্ত উইকেট গিয়ে জমা পড়ত বা-হাতি অফ স্পিনারদের পকেটে। এমনকি বিশ্বের বাঘা-বাঘা সব দলেও একজন পেসারের আধিপত্যই চোখে পড়ছে অধিকাংশ সময়ে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান চিত্রটা ভিন্ন। বেশ রঙিন।
ঠিক যেসব কারণে বাংলাদেশ দল শিরোপা জয়ের স্বপ্ন বুনছে, সেসবের উপরের দিকেই থাকছে টাইগারদের বর্তমান পেস আক্রমণ। অ্যালান ডোনাল্ডের অধীনে যেন ভিন্ন এক রুপে আবির্ভূত হয়েছে বাংলাদেশের পেসাররা। মুস্তাফিজুর রহমান, তাসকিন আহমেদ, হাসান মাহমুদ, এবাদত হোসেন, শরিফুল ইসলামরা বাংলাদেশের বর্তমান পেস ইউনিটের নিয়মিত সেই সাথে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
এদের প্রত্যেকেই পারফরমার। বিশেষ করে সাদা বলের ক্রিকেটে। শুধুমাত্র ২০২৩ বছরটা বিবেচনায় নিলে, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি উভয়ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ উইকেট শিকার করেছেন একজন পেসার। টি-টোয়েন্টিতে তাসকিন, ওয়ানডেতে হাসান মাহমুদ।
টি-টোয়েন্টিতে তাসকিন আহমেদ শিকার করেছেন ১৬টি উইকেট। অন্যদিকে ওয়ানডেতে হাসানের শিকার ১২টি। যেহেতু বছরটা ওয়ানডে বিশ্বকাপের, তাই টি-টোয়েন্টির হিসেবটা না হয় তোলা থাক। যদি ওয়ানডের হিসেবটাই করা যায়।
বাংলাদেশের পেসারদের পকেটে ঢুকেছে ৪৯টি উইকেট। অথচ বাংলাদেশ দল প্রতিপক্ষের ৮৩টি উইকেট শিকার করেছে নিজেদের খেলা ১২ ম্যাচে।পেসারদের মধ্যে সর্বনিম্ন উইকেট শিকার করেছেন শরিফুল ও মুস্তাফিজ।
দুইজনই সাতটি করে উইকেট নিয়েছেন। অন্যদিকে তাসকিন হাসানের সমান ১২টি ও এবাদতের শিকার ১১টি উইকেট। বাংলাদেশের জার্সিতে ওয়ানডে খেলা একমাত্র মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি এই বছর রয়েছেন উইকেট শূন্য অবস্থানে।
কিন্তু কয়েকটা বছর আগেও তো বাংলাদেশের এমন সাফল্য ঘুনাক্ষরে চিন্তা করা যেত না। ঘরের মাঠে বাংলাদেশের সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হত স্পিনারদের। তাছাড়া তিরস্কার সহ্য করতে হত বাংলাদেশের উইকেটকে, বিশেষ করে শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের।
দলের নিয়মিত পাঁচ পেসারদের মধ্যে যেন চলছে সুস্থ এক প্রতিযোগিতা। সম্ভবত এমন মধুর এক প্রতিযোগিতা চলছে না বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ঘরেও। আর বাংলাদেশের ইতিহাসেই তো এমন পেস ইউনিট বেশ বিরল। ম্যাচের প্রতিটা সময়ের জন্যেই পেসাররা প্রস্তুত থাকছেন।
হোক সেটা নতুন বলের শুরু কিংবা স্লগ ওভার। এমনকি মাঝের ওভারগুলোতেও বাংলাদেশের পেসাররা কার্য্যকর সব ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। শুরুতে হাসান, আর তাসকিন সামলে নিচ্ছেন। মাঝের ওভারে কখনো এবাদত আবার কখনো মুস্তাফিজ। শেষের দিকে মুস্তাফিজ আর হাসানের যুগলবন্দী তো ‘চেরি অন টপ’।
পেসারদের এমন দূর্দান্ত সময়ে তাদেরকে প্রতিদান দিতেও আবার বাংলাদেশ পিছপা হচ্ছে না। টিম ম্যানেজমেন্ট তিন পেসার নিয়ে খেলার সাহস দেখাচ্ছে। অথচ নিকট অতীতেও বাংলাদেশের একাদশে একজন পেসার থাকাটা ছিল নিয়মিত চিত্র। সেই চিত্র পালটে দিয়েছেন, তাসকিন, হাসান, এবাদতরা।
এমন ইতিবাচক পেস আক্রমণের কারণেই তো বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বড় কোন শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখছে। ভয় পাচ্ছে না কোন প্রতিপক্ষকেই। তাছাড়া এমন সৌভাগ্যও তো আর জোটে না সব দেশের কপালে। এখন বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের একটাই চাওয়া- এই পেসাররা থাকুক ইনজুরি মুক্ত।
তাইতো এবাদতকে নিয়ে কোনরকম ঝুঁকি নিচ্ছে না দল। তাকে ইনজুরি কাটিয়ে ওঠার পর্যাপ্ত সময়ই দেওয়া হচ্ছে। তার বদলে তরুণ তানজিম হাসান সাকিব যাচ্ছেন এশিয়া কাপে। তরুণ এই পেসারও এমন সুস্থ প্রতিযোগিতার আবহাওয়ায় হয়ে উঠতে পারেন ভয়ানক। আর তাতে অবশ্য লাভটা বাংলাদেশেরই।
এই ভাল সময়ের সবচেয়ে বড় পুরষ্কারটা হতে পারে এশিয়া কাপ কিংবা বিশ্বকাপ জয়। বাংলাদেশের এই পেস ব্যাটারি নিশ্চয়ই সেই লক্ষ্যেই নিজেদের প্রস্তুত করছে। তাদেরকে নিবিড় পরিচর্যায় তো থাকছেনই কিংবদন্তি সাদা বিদ্যুৎ।