বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের বেশ নামডাক। টি-টোয়েন্টির জমানায় ক্রিকেট বিশ্বে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট এখন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। এই আইপিএলের শুরুটা ২০০৮ সালে হলেও ১৯৯৬ সালে সর্বপ্রথম আইপিএল আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বর্তমান আইপিএলের চেয়ারম্যান লোলিত মোদি। অর্থের ঝনঝনানি, গ্ল্যামার কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বীতা সবই আছে আইপিএলে।
- কখন লোলিত মোদি প্রস্তাব দেয়?
১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের পর বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়াকে (বিসিসিআই) ৫০ ওভারের একটি টুর্নামেন্ট শুরু করার প্রস্তাব দেয়। যেখানে দেশ-বিদেশের তারকা ক্রিকেটার সহ তরুন ক্রিকেটাররাও সুযোগ পাবে খেলার। তখন বিসিসিআই প্রধান ছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। তিনি এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলেন।
১৯৯৯ সালে হিমাচল প্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনকে (এইচপিসিএ) ২৫ লাখ রুপি অনুদান দেন মোদি। লক্ষ্য ছিল বিসিসিআইতে আসা। এরপর তিনি রাজস্থান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেন যাতে করে বিসিসিআই’র উচ্চপর্যায়ে তিনি যেতে পারেন।
অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পর সুযোগ আসলো ২০০৪ সালে। যখন বসুন্ধরা রাজে রাজস্থানের চিফ মিনিস্টার হিসেবে নিযুক্ত হলেন। পরের বছরই ছিলো ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন। ভোটে জিততে হলে তৎকালীন চেয়ারম্যান কিশোর রঙ্গতাকে হারাতে হবে!
ওই রাজ্যের ৩২ জেলা সহ আরও ৬৬ ভোটার ছিল। সেবার প্রেসিডেন্ট পদে মাত্র এক ভোটে ব্যবধানে রঙ্গতাকে হারিয়ে নির্বাচিত হন লোলিত মোদি। এবং শীগ্রই বিসিসিআইয়ের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে হিসেবে নির্বাচিত হন মোদি!
- লোলিত মোদি কি করেছিলেন?
মোদি বুঝতে পারলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পরিকল্পনার ছকটা আগেই কষা। টি-টোয়েন্টি লিগ চালু করতে চান তিনি। এই পরিকল্পনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ১১ বছর ধরে! ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মিসবাহ উল হকের প্যাডেল সুইপে শ্রীশান্ত বল লুফে নিতেই পাকিস্তানকে হারিয়ে প্রথম আসরেই বিশ্বকাপ জয় করে ভারত। সেদিন যদি ভারত হেরে যেতো, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট এতো জনপ্রিয় হতো কি?
তখন থেকেই মোদি সতীর্থদের কাছে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট করার স্বপ্ন নিয়ে বলতে থাকে। স্পনসর চেয়ে টেন্ডারও দেন তিনি, মিডিয়া স্বত্ব, দলের স্পন্সর, সিরিজে স্পন্সর খুঁজতে থাকেন। এরপর বিসিসিআই তখন ভারত জাতীয় দলের জন্য নাইকির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিটা ছিল ৪৫ মিলিয়ন ডলারের! খ্যাতনামা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাহারার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় ৩১৩ কোটি রুপিতে।
মোদি যখন ক্রীড়া সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নাইকির সাথে চুক্তি সাক্ষর করলেন তখন বোর্ডের একজন সিনিয়র সদস্য মোদিকে উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘এক টিক মারলা আর কোটি টাকা’। এরপর ২০০৬ সালে নিম্বাস চার বছরের জন্য ২১২ মিলিয়ন ডলারে টিভি স্বত্ব কিনে নেয় যা প্রায় ২৫০০ কোটি রুপির সমান!
- ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল কতটা ভূমিকা রেখেছে?
সেপ্টেম্বর ১৩, ২০০৭। মোদি তখন আইপিএলের আহবায়ক চ্যাম্পিয়নস লিগ টি-টোয়েন্টির মাধ্যমে অফিসিয়ালি টি-টোয়েন্টি লিগ শুরু করেন। একদিন বাদেই জোহানেসবার্গে বোল-আউটে পাকিস্তানকে গ্রুপ পর্বে হারায় ভারত। নতুন ফরম্যাটের জন্য এটা ছিল অসাধারণ এক বিজ্ঞাপন। মোদি খুশিতে আত্মহারা হয়ে মাঠ ছুটে যান। যদিও মাঠে যাওয়ার সেই অনুমতি তাঁর ছিল না, তবে আইসিসি অফিসিয়ালসদের বাঁধা না মেনেই তিনি দৌড় দেন।
সেই বিশ্বকাপ দলে থাকা রবিন উথাপ্পা সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আমার মনে আছে লং অন থেকে আমি যখন দৌঁড় দেই, আমি বলছিলাম প্লিজ গড তাকে ক্যাচটা ধরতে দেও! কারণ আমি জানতাম শ্রীশান্তের চোখে সমস্যা আছে। আমার মনে হয় আমি তখন মিড অনে পৌঁছে গেছি যখন সে ক্যাচ ধরে। আমরা তখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। আমি পরের তিনরাত ঘুমাতে পারিনি। আমার বয়স তখন ২১, আমি স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম। আমি জানি আমি বিশেষ কিছু একটা অর্জনের সাথী হয়েছি। আমার মনে আছে অজিত আগারকার বার বার বলছিল আমরা কি অর্জন করেছি তোমরা কি জানো?’
এটা যে শুধু ধোনির নেতৃত্বে ভারতের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা জয় তাই নয়, এই বিশ্বকাপের পরই পর্দা উঠে আইপিএল। মূলত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ (আইসিএল) নিষিদ্ধ হওয়ার পরই লোলিত সুযোগ পান এই টুর্নামেন্ট নিয়ে আগানোর।
একদিন বার্ষিক সভায় তিনি প্রস্তাব দিয়েই বসেন! এরপর শুরু হয় স্বত্ব বিক্রি, খেলোয়াড়দের তালিকা করা। আইপিএল পরিকল্পনা চলাকালীনই টুর্নামেন্টের সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করেছিলেন মোদি। এমনকি বিক্রি করে দিয়েছিলেন ইভেন্ট স্বত্বও। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে লোলিত মোদির স্বপ্নের আইপিএল মাঠে গড়ায় ২০০৮ সালের ১৮ এপ্রিল। বাকিটা তো স্রেফ ইতিহাস!