আমাদের ভাই, আমাদের বন্ধু

২০০৮ সালে মোহাম্মদ রফিক অবসরে গেলেন। আমরা রফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার পর দেশের সেরা স্পিনার হবে কে? রাজ্জাক, সাকিবকে ছেড়ে রফিক ভাই এই রুবেলের নাম করেছিলেন। রুবেল হয়তো এই মশালটা বহন করেই যেতেন।

মোশাররফ রুবেল আমাদের কে ছিলেন?

জাতীয় দলের ক্রিকেটার ছিলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটের গ্রেট ছিলেন। আমরা সাংবাদিক। তাই পেশাদার একটা সম্পর্ক থাকারই কথা ছিলো। কিন্তু রুবেলের সাথে এই পোশাকি সম্পর্কটা কবে যেনো আমাদের ঝরে পড়েছিলো।

সম্ভবত আবাহনী মাঠের কোনো এক অনুশীলনে প্রথম দেখেছিলাম। আমাদের কাছাকাছি বয়স; বছর দুয়েকের ছোট। আমাদের এক সহকর্মীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘রুবেল যেমন ভালো ছাত্র, তেমন ভালো অলরাউন্ডার।’

হ্যা, রুবেলকে আমরা অলরাউন্ডার বলে চিনতাম।

২০০১ সালের দিকে প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট শুরু করেছিলেন। তার আগেই চেনা নাম হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকার ক্রিকেটে খেলতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন; আলাদা একটা পরিচিতি তার ছিলোই।

একটা সময় জাতীয় দলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের অভাব ছিলো না। কিন্তু এই যুগে এসে সেটার বড়ই অভাব হয়ে পড়েছিলো। এই সময়ে শাহরিয়ার নাফীস, মোশাররফ রুবেলরা ছিলেন ব্যতিক্রম। রুবেল ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। সে জন্যই কি না, বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন।

২০০৮ সালে মোহাম্মদ রফিক অবসরে গেলেন। আমরা রফিক ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তার পর দেশের সেরা স্পিনার হবে কে? রাজ্জাক, সাকিবকে ছেড়ে রফিক ভাই এই রুবেলের নাম করেছিলেন। রুবেল হয়তো এই মশালটা বহন করেই যেতেন।

রফিকের অবসরের পরই, ওই বছরই দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক হয়ে যায় তার। তেমন কোনো পারফরম্যান্স ছিলো না; কিন্তু সম্ভাবনা ছিলো। সেই সম্ভাবনাকে দৃশ্যত শেষ করে দিয়েছিলো আইসিএল। এক ঝাক মেধাবি ক্রিকেটারের সাথে রুবেলও পাড়ি জমিয়েছিলেন ভারতে।

আইসিএল নিষেধাজ্ঞার পর অনেকেই আবার জাতীয় দলের স্রোতে ফিরে এসেছিলেন। রুবেলকে সে জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছিলো। তবে হাল ছাড়েননি।

২০১৩ সাল থেকে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের দারুন পারফরমার ছিলেন। সে বছর বিপিএলের ম্যাচসেরা হয়েছিলেন ফাইনালে। এরপর থেকে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন দারুণ লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। ২০১৬ সালে পুরষ্কার পেয়েছিলেন। আট বছর বিরতি দিয়ে আবার জাতীয় দলে ফিরেছিলেন। ফিরে ক্যারিয়ার সেরা বোলিংও করেছিলেন।

এরপরও হয়তো রুবেল স্বপ্ন দেখতেন। ‘হয়তো’ বলি কেন? রুবেলের বুক ভরা স্বপ্নই ছিলো। সবসময় চাইতেন পারফরম করতে, আবার জাতীয় দলে ফিরতেন। ২০১৯ সালে প্রথম যখন ব্রেন টিউমার ধরা পড়লো, তার পরেও মাঠে ফেরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সময় তার কাছ থেকে আস্তে আস্তে সব কেড়ে নিয়েছে।

সুন্দর গোছানো সংসার ছিল; একটা মাথা গোজার ঠাই ছিলো। এই মারণব্যধির সাথে লড়তে গিয়ে সবই গেছে। এই সময়ে তার স্ত্রী নিজেকে মহীয়সী এক নারী হিসেবে প্রমাণ করেছেন। দৃঢ়তার সাথে সামলেছেন সব, রোমান্টিকতার সাথে রুবেলের শেষ সময়টা সুন্দর করে রেখেছেন।

শেষ সময়টা পর্যন্ত রুবেলের কণ্ঠের সেই বিনয়টা, সেই মাধুর্যটা, সেই ভালোবাসাটা ছিলো। মাস দেড়েক আগেও ফোনে কথা হয়েছিলো। তখন তার মানুষ চিনতে কষ্ট হয়, কথা বলতে কষ্ট হয়। এর মধ্যেও বলেছিলেন, ‘দাদা, দোয়া করবেন।’

দোয়া রইলো, রুবেল। আপনিই চলে গেলেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...