‘আন্ডাররেটেড’ এক ক্রিকেট দ্রোণাচার্য

গত শতকের সাতের দশকের শুরুর দিকে বোম্বে ক্রিকেট লিগের এক ম্যাচে তারকাখচিত বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখোমুখি দাদার ইউনিয়ন ক্লাব। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে খেলছেন দিলীপ ভেঙসরকার, সন্দীপ পাতিল, সুরু নায়েকের মতো উঠতি প্রতিভারা। অন্যদিকে দাদারের ক্লাবটির অধিনায়ক সেই বাসুদেও পরাঞ্জপে। ভিজে স্যাতস্যাতে পিচে প্রথমে ব্যাট করে ৯২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো বেকায়দায় পরে যায় দাদারের ক্লাবটি।

বাসুদেও জগন্নাথ পরাঞ্জপে।একজন ভারতীয় ক্রিকেটার। ১৯৫৬ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বোম্বে ও বরোদার হয়ে মাত্র ২৯ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছিলেন। মূলত ডানহাতি ব্যাটসম্যান ছিলেন। প্রায় ২৪ ছুঁইছুঁই গড়ে করেছিলেন মাত্র ৭৮৫ রান। শতরান করেছিলেন দুটি। বারো বার রঞ্জিজয়ী বোম্বে দলের সদস্য ছিলেন। দেশের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি কখনোই।

একজন ক্রিকেটার হিসাবে এর থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু বলার নেই তার সম্মন্ধে। কিন্তু তারপর ? এই প্রসঙ্গে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক তাহলে।

এক

গত শতকের সাতের দশকের শুরুর দিকে বোম্বে ক্রিকেট লিগের এক ম্যাচে তারকাখচিত বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখোমুখি দাদার ইউনিয়ন ক্লাব। বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে খেলছেন দিলীপ ভেঙসরকার, সন্দীপ পাতিল, সুরু নায়েকের মতো উঠতি প্রতিভারা। অন্যদিকে দাদারের ক্লাবটির অধিনায়ক সেই বাসুদেও পরাঞ্জপে। ভিজে স্যাতস্যাতে পিচে প্রথমে ব্যাট করে ৯২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো বেকায়দায় পরে যায় দাদারের ক্লাবটি।

কিন্তু, সবাইকে হতবাক করে দিয়ে সেই অবস্থায় ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন দাদারের অধিনায়ক পরাঞ্জপে। ব্যাট করতে নেমে ভেঙসরকার, পাতিলরা মাত্র ৫৫ রানে অল আউট হয়ে যান। খেলা শেষে পরাঞ্জপে বলেন, ‘আমি জানতাম যেখানে আমার দলের সুনীলের রান করতে এতো সমস্যা হচ্ছে , সেখানে অন্য কোনো ব্যাটসম্যানের পক্ষে রান করা খুব কষ্টকর । তাই ম্যাচটি জেতার লক্ষ্যেই অল্প রানে ইনিংস ডিক্লেয়ারের সিদ্ধান্ত।’

নিজের দলের কোনো ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং প্রতিভার উপর কতটা বিশ্বাস থাকলে এমন সিদ্ধান্ত অধিনায়ক নিতে পারেন, এই ঘটনা তারই প্রমান। সেই উঠতি ব্যাটসম্যান ‘সুনীল’ই পরবর্তী কালের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান সুনীল গাভাস্কার।

দুই

ভারতীয় অনূর্ধ্ব পনেরো জাতীয় শিবিরে কোচ তখন তিনি। ইন্দোরের আবাসিক শিবিরে একটি বছর পনেরোর ছেলের ব্যাটিংয়ে চোখ আটকে যায় তাঁর। বোম্বে রঞ্জি দলের প্রধান নির্বাচকের সাথে সরাসরি কথা বলে সেই ছেলেটিকে বোম্বে রঞ্জি দলে সুযোগ করে দিলেন তিনি। শুধু তাই নয় , পরের বছর ভারতীয় দলের পাকিস্তান সফরের আগে তিনি নিজে কথা বলেন বোর্ড সভাপতি রাজ সিং দুঙ্গারপুরের সাথে সেই বছর ষোলোর ছেলেটিকে জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য।

রাজ সিংহ যখন তাঁর বয়সের কথা ভেবে বলেন পাকিস্তানের ইমরান, আকরামদের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে গিয়ে ব্যাথা লেগে যেতে পারে ছেলেটার , উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই ছেলে ব্যাথা লাগার ছেলে নয়, ব্যাথা লাগানোর ছেলে।’ মূলত তাঁর কারণেই পাকিস্তানগামী বিমানের টিকিট পেয়েছিলো সেই ছেলেটি। আজ সে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার।

তিন

ভারতীয় ক্রিকেট একাডেমিতে ব্যাটসম্যান হিসাবে যোগ দিলো এক পছর পনেরোর ছেলে। পড়াশোনাতেও মেধাবী। কিন্তু একাডেমির প্রধান কোচ বাসুদেও পরাঞ্জপের জহুরি চোখ চিনে নিলো সেই ছেলেটির আসল প্রতিভা। তাঁর পরামর্শে লেগ স্পিন করতে মন দিলো সে। ধীরে ধীরে তাঁর তত্বাবধানে হয়ে উঠলো দেশের সেরা লেগ স্পিনার। সেই ছেলেটিই আরেক কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে।

চার

ভারতীয় ক্রিকেট একাডেমিতে একটি বছর চৌদ্দর ছেলে উইকেটরক্ষক হিসাবে সুযোগ পায়। কিন্তু কোচ বাসুদেও পরাঞ্জপের নির্দেশে সে ব্যাটিংয়েই বেশি মনোযোগ দিতে থাকে। কোচের জহুরি চোখ চিনতে ভুল করেনি তাঁর সুপ্ত প্রতিভা, ধীরে ধীরে উইকেট রক্ষক থেকে দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হয়ে উঠলো ছেলেটি।

সে রাহুল দ্রাবিড়। মজার ব্যাপার হল, সৌরভ গাঙ্গুলির দলে পরবর্তীতে উইকেটরক্ষণের কাজটা রঙিন পোশাকে লম্বা সময় ধরে করেন এই রাহুল দ্রাবিড়!

পাঁচ

মুম্বাইয়ের স্কুল ক্রিকেটে একটি অনামী স্কুলের হয়ে খেলা একটি বাচ্চা ছেলের ব্যাটিং দেখে চোখ আটকে গেলো তাঁর। তাঁর অনুরোধে মুম্বাই অনূর্ধ্ব ১৫ দলে স্থান পেলো ছেলেটি । তাঁর সুপারিশেই প্রবীণ আমরে, কিরণ মোরের মতো কোচেদের কাছে খেলা শেখার সুযোগ পেলো সে। ধীরে ধীরে হয়ে উঠলো বর্তমান সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ছেলেটির নাম রোহিত শর্মা।

উপরোক্ত ঘটনাগুলি থেকেই প্রমান হয় , প্রতিভা চেনার এবং প্রতিভা খুঁজে বের করার এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর ক্রিকেট জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছে অসংখ্য তরুণ প্রতিভাদের। তাঁর প্রত্যক্ষ কোচিং ও মেন্টরশীপে ভারতীয় জাতীয় দলে খেলেছেন বহু তরুণ প্রতিভা।

সুনীল গাভাস্কার , দিলীপ বেঙ্গসরকার , সঞ্জয় মঞ্জরেকার , শচীন তেন্ডুলকর , নরেন্দ্র হিরোয়ানি , অনিল কুম্বলে , ভেঙ্কটপতি রাজু , রাহুল দ্রাবিড় ,যুবরাজ সিং, রমেশ পাওয়ার , রোহিত শর্মারা তাই তাদের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পিছনে শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করেন তাদের প্রিয় ‘বাসু স্যার’ অবদান। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন ‘ক্রিকেটের দ্রোণাচার্য’।

৮২ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত রোগে প্রখর ক্রিকেট মস্তিষ্কের অধিকারী বাসুদেও জগন্নাথ পরাঞ্জপে জীবন নদীর ওপারে চলে যান ২০২১ সালে। ক্রিকেট মহল যাঁকে বাসু পরাঞ্জপে নামেই চেনে। রেখে গেলেন অসংখ্য গুণমুগ্ধ কিংবদন্তি ছাত্রদের। তাঁর সন্তান যতীন পরাঞ্জপেও দেশের হয়ে একদিনের ম্যাচ খেলেছিলেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...