প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ফ্যাব ফোর

একটা সময় এমন এসেছিল যখন ভারতের মিডল অর্ডার বিশ্ব ক্রিকেটের ঈর্ষার বিষয় ছিল। শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি আর ভিভিএস লক্ষ্মণ মিলে আমাদের ক্রিকেটকে যে নির্ভরতা এনে দিয়েছিল তাঁর তুলনা অন্তত ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে আর নেই।

ভারতীয় ক্রিকেটে বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানের সংখ্যা খুব কম নয়। দুই বিজয় – মার্চেন্ট এবং হাজারে থেকে আরম্ভ করে সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেনডুলকার হয়ে আধুনিক যুগে বিরাট কোহলি – এদের সবাইকেই ক্রিকেট বিশ্ব যথেষ্ট সমাদরের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে, গ্রেট ব্যাটসম্যান হিসেবে মেনে নিয়েছে।

তবে একটা সময় এমন এসেছিল যখন ভারতের মিডল অর্ডার বিশ্ব ক্রিকেটের ঈর্ষার বিষয় ছিল। শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলি আর ভিভিএস লক্ষ্মণ মিলে আমাদের ক্রিকেটকে যে নির্ভরতা এনে দিয়েছিল তাঁর তুলনা অন্তত ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে আর নেই।

কিন্তু চ্যাম্পিয়নদের আসল পরীক্ষা হয় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। অপরিচিত পরিবেশে, দুরন্ত বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে যদি কোন ব্যাটসম্যান ধারাবাহিক সাফল্য পান তবেই তাকে গ্রেট ব্যাটসম্যানের দলে রাখা যেতে পারে। আমাদের ফ্যাবুলাস ফোরের পারফর্মেন্স এইমাপকাঠিতে ঠিক কেমন?

আজ আমরা দেখব বিদেশের মাটিতে শক্তিশালী বোলিংয়ের বিরুদ্ধে এই চারজন ব্যাটসম্যান কেমন পারফর্ম করেছেন। এখানে শক্তিশালী বোলিং বলতে এমন বোলিং আক্রমন বোঝাতে চেয়েছি যাতে অন্তত দুজন বিশ্বমানের বোলার রয়েছেন। যেমন ১৯৮৯-৯০এর পাকিস্তান (আকরাম-ইমরান-ওয়াকার) বা ১৯৯৯-২০০০এর অস্ট্রেলিয়া (ম্যাকগ্রা–ওয়ার্ন–ফ্লেমিং)। ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমন ঠিক এই পর্যায়ে ২০১১-এর আগে ওঠেনি বলে সেই টিমের বিরুদ্ধে পারফর্মেন্স এখানে ধরা হবে না। যেমন ধরা হবে না ২০০৩-০৪এর সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে পারফর্মেন্স।

অন্য তিনজনের চেয়ে সচিনের আবির্ভাব আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মঞ্চে বেশ কয়েক বছর আগে ঘটেছে। আর শুরুতেই আগুনের মুখে। যদিও সেই সিরিজে ভারতের হয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পারফর্মেন্স করেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকর, ১৬ বছরের বিশ্বয়-বালককেও ব্যর্থ বলা যাবে না কোন মাপকাঠিতেই। সেই সিরিজে প্রায় ৩৬ গড়ে ২১৫ রান করেন শচীন।

তবে আমরা প্রাথমিক ভাবে সেই সিরিজগুলি নিয়ে আলোচনা করব যাতে চারজনই একসঙ্গে খেলেছিলেন। এইরকম সিরিজ মোট ছয়টি। ১৯৯৬-৯৭এর দক্ষিণ আফ্রিকা সফর দিয়ে আরম্ভ। তখন দক্ষিন আফ্রিকার বোলিঙের মুল স্তম্ভ ছিলেন ‘হওয়াইট লাইটনিং’ নামে খ্যাত আল্যান ডোনাল্ড এবং লাইন – লেন্থ – সুইঙ্গের ওপর অসাধারণ নিয়ন্ত্রনের অধিকারী শন পোলক। সেই সিরিজ ভারতের পরাজয় হয় ২-০ ব্যাবধানে।

এরপরের সিরিজ সেই বছরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। তাদের বোলিং আক্রমণও কম শক্তিশালী ছিল না। এম্ব্রজ, ওয়ালস এবং বিশপে সমৃদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং লাইন আপের যে কোন দলের ব্যাটিং ধ্বসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। ১৯৯৯-০০ সালের অস্ট্রেলিয়া দলের বোলিংয়ের আগেই উল্লেখ করেছি। ২০০১ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিংকেও যথেষ্ট শক্তিশালী ধরা হয়।

ততদিনে ডোনাল্ড রিটায়ার করলেও পোলকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিপক্ষকে বেকায়দায় ফেলার জন্যে মাখায়া এনতিনি এসে গেছেন। ২০০৬-০৭এর দক্ষিন আফ্রিকার আক্রমন আরও ক্ষুরধার – এবার আগের দুজনের সঙ্গে যোগ দেবেন আরও একজন অলটাইম গ্রেট ফাস্ট বোলার – ডেল স্টেইন। ২০০৭-০৮এর অস্ট্রেলিয়ার আক্রমনের ধার ম্যাকগ্রা – ওয়ার্নের অবসরের পর একটু কমলেও ব্রেট লি – মিশেল জনসন – স্টুয়ার্ট ক্লার্কের আক্রমণও যথেষ্টই শক্তিশালী ছিল।

সামগ্রিক ভাবে এই টেস্টগুলিতে ভারতের বিপক্ষে ফল ছিল ১১-২। বোঝাই যাচ্ছে, দল হিসেবে তেমন সুবিধে করতে পারিনি আমরা। কিন্তু আমাদের ফ্যাব ফোর? তাদের কী হাল হয়েছিল এই সিরিজগুলিতে?

ব্যাটিং অর্ডার হিসেবে শুরু করা যাক। অর্থাৎ ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ তিন নম্বর ব্যাটসম্যান রাহুল দ্রাবিড়কে দিয়ে আরম্ভ। এই ছয়টি সিরিজে রাহুলের মোট রান ১১৯৪, গড় ৩৫.১১। বেশ ভালো পারফর্মেন্স যদিও সেটা তার ক্যারিয়র আভারেজের চেয়ে বেশ কিছুটা কম। রাহুলের সর্বাধিক সফল সিরিজ অ্যামব্রোস, ওয়ালশ, বিশপদের বিরুদ্ধে ১৯৯৬-৯৭ সালে ৭২ গড়ে ৩৬০। তিনি ব্যর্থতার সম্মুখীন হন ১৯৯৯-০০ সালের অস্ট্রেলিয়া (১৫.৫ গড়ে ৯৩ রান) এবং২০০৬-০৭ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে (২০.৮৩ গড়ে ১২৫ রান)। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে পরে আরও একটি সিরিজ খেলেন দ্রাবিড়, তার আগেই সৌরভের ক্যারিোরে যবনিকা পড়ে যাওয়ায় এই সিরিজ আপাতত হিসেবের মধ্যে রাখা হয়নি।

এবার ব্যাট হাতে নাববেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান, শচীন টেনডুলকার। শচীনের মোট সংগ্রহ ১৬৯৩, গড় ৫১.৩০। এই ছয়টা সিরিজের কোনটাতেই শচীনের গড় ৩০এর নিচে নাবেনি। অর্থাৎ তাকে পুরোপুরি ব্যর্থ কোন সিরিজেই বলা যাবে না।

তিনটে সিরিজে তার গড় ৫০এর ওপরে – ১৯৯৬-৯৭ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর, ২০০১ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা সফর (পোলক – এনটিনির বিরুদ্ধে) এবং ২০০৭-০৮এর অস্ট্রেলিয়া সফর (লি, জনসন, ক্লার্কদের বিরুদ্ধে)। মোটের ওপর অসাধারণ পারফর্মেন্স। নিজের সুনামের ওপর সম্পূর্ণ সুবিচার করতে সফল হয়েছেন শচীন এই কঠিন সফরগুলিতেও। তবে ম্যাকগ্রা, ডোনাল্ড বা স্টেইনদের শচীন তাদের দেশে ঠেঙিয়ে আসতে পারলে আরও আনন্দিত হতাম আমরা।

সৌরভের বিদেশে মুল খ্যাতি তার ইংল্যান্ডে অসাধারণ পারফর্মেন্সের জন্যে। দুঃখের কথা এটাই যে ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমন সৌরভের খেলা সিরিজগুলিতে যথেষ্ট উঁচুমানের ছিল না বলে এখানে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে না। এই সিরিজগুলিতে সৌরভের মোটরান ৯৯৬, গড় ৩২। ডেল স্টেইন, পোলক এবং এনটিনির দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ২০০৬-০৭ সালের সিরিজে ভালো পারফর্মেন্স দেখান সৌরভ (৪২.৮ গড়ে ২১৪)। এছাড়া বাকি সিরিজগুলোয় ওনার গড় ৩০এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করেছে (৯৭-৯৭এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর ছাড়া, এই সিরিজে ১৯.৫ গড়ে ৭৮ রান করেন সৌরভ)।

সবশেষে আসবেন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ম্যাচ বের করার জন্যে বিখ্যাত ভিভিএস। আলোচ্য ছয়টা সিরিজে লক্ষনের মোট রান ১১২৯, গড় ৩৮.৯৩। একমাত্র ১৯৯৬-৯৭এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তার গড় ৩০এর নিচে ছিল (২৮.৭)। সব মিলিয়ে যথেষ্ট ভালো পারফর্মেন্স লক্ষণেরও। একটা মাপকাঠিতে সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন লক্ষ্মণ। তবে সেই আলোচনা পরে।

সামগ্রিক দৃষ্টিতে এই ছয় সিরিজে শচীনের অন্য সবার চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। তারপর আসবেন যথাক্রমে লক্ষ্মণ, দ্রাবিড় এবং সৌরভ।

ওপরের আলোচ্য ছয়টা সিরিজ ছাড়াও কিন্তু শচীন, রাহুল আর লক্ষণ আরও দুটো কঠিন বিদেশ সফরে অংশগ্রহণ করেছেন – ২০১০-১১ দক্ষিণ আফ্রিকা (ডেল স্টেইন আর মরকেল) এবং ২০১১ সালে ইংল্যান্ড (এন্ডারসন – ব্রড)। এই দুটোর মধ্যে প্রথমটায় দুর্ধর্ষ পারফর্ম করেন শচীন (৮১.৫ গড়ে ৩২৬)। লক্ষণও বেশ ভালো (১৯৬ রান, গড় ৩৯.২)। এই সিরিজে সুবিধে করতে পারেননি রাহুল (২০র গড়ে ১২০ রান)।

ছবিটা বদলে যায় ২০১১ সালের ইংল্যান্ড সফরে। ইনিংস প্রতি প্রায় ৬৭ গড়ে রাহুল এই সফরে ৪৬১ রান করেন, সচিনের সংগ্রহ ৩৪ গড়ে ২৭৩। ২৩এরও কম গড়ে এই সিরিজে মাত্র ১৮২ রান করেন লক্ষণ। এই দুটো সিরিজ ধরলে রাহুলের গড়রান (৩৮.৫৯) লক্ষণকে ছাপিয়ে যাবে (৩৫.৮৮)। তবে শচীনের গড়ে তেমন ফারাক পড়ে না (৫০.৯৩)।

সচিন অবশ্য অন্য তিনজনের চেয়ে অনেকটাই সিনিয়র হওয়ায় আরও তিনটে কঠিন সফর খেলে ফেলছেন অন্যরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রবেশ করার আগেই। প্রথমটা আবির্ভাবেই ফুটন্ত কড়াইয়ের মাঝখানে – ইমরান, আক্রাম, ওয়াকারের বিরুদ্ধে ১৯৮৯-৯০এর পাকিস্তান সফর। মাত্র ১৬ বছরের শচীন ৩৬ গড়ে ২১৫ রান করে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিলেও সেই সিরিজের প্রধান স্টার ছিলেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার।

এরপর ক্রেইগ ম্যাকডরমট এবং মার্ভ হিউজের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯১-৯২ সালে ৪৬ গড়ে ৩৬৮ রান করেন সচিন। এরপর ১৯৯১-৯২ সালে ডোনাল্ড-শুলজ-ম্যাকমিলান-ক্যালিসের বিরুদ্ধে ৩৭ গড়ে ২০২ রান করেন। যদিও এই তিনটে সিরিজেই সচিনের গড় ৫০এর নিচে থেকেছে, সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে এই সিরিজগুলি শচীন খেলেন যখন তার বয়স কুড়ি ছোঁয়নি। এই তিনটে সিরিজ মিলে সচিনের মোট রান ৭৮৫, গড় ৩৯.২৫। হেলাফেলা করার মতো নয় কখনই।

এখনও পর্যন্ত যতগুলি সিরিজ নিয়ে আলোচনা করলাম তাতে ভারতের বিরুদ্ধে হারজিতের হিসেব হচ্ছে ২১-৩। যে তিনটে ম্যাচে ভারত জিতেছে তার মধ্যে তিনটেতেই শচীন, রাহুল এবং লক্ষ্মণ খেলেছেন, সৌরভ দুটিতে। ভারতের এই তিনটে জয়ে সচিন ২৭.১৭ গড়ে ১৬১ রান করেছেন। রাহুল ২৬ গড়ে ১৬৬। সৌরভ ২৮.৩৩ গড়ে ৮৫। এবং ভিভিএসের অবদান ৫৬.৮৩ গড়ে ৩৪১।

অর্থাৎ ভারতের জয়ে সর্বাধিক অবদান কিন্তু সেই লক্ষ্মণেরই। এর মধ্যে একটা ম্যাচে তিনি ম্যান অফ দ্য ম্যাচও হন (২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে, ডারবানে)। অন্য দুটি ম্যাচে এই পুরস্কার পান ইরফান পাঠান এবং শ্রীশান্থ।

আমাদের ফ্যাব ফোরের সম্মিলিত অবদান এর মধ্যে কোনও কঠিন সিরিজ জেতাতে পারেনি ভারতকে। ড্র করেছিল একমাত্র ২০১০-১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে (১-১)।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...