বিপ্লব আনা বিদ্রোহী

অ্যাশেজ টেস্ট সম্প্রচার-স্বত্ব পাননি বলে ক্রিকেটের এত বড় ‘ক্ষতি’ করতে হবে! আপনি সব দেশের নামী ক্রিকেটারদের মোটা অংকের অর্থ দিয়ে নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ খেলতে হয়েছিল অবসরে যাওয়া ববি সিম্পসনকে ফিরিয়ে এনে। অর্থের দম্ভের এক পর্যায়ে আপনি অস্ট্রেলিয়ান বোর্ডকেই কিনে নিতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের সেই ঐতিহাসিক মিটিংয়ে আপনি তাদের বলেছিলেন, ‘জেন্টেলম্যান, আমাদের সবার মধ্যে একটু-আকটু বেশ্যা লুকিয়ে থাকে। তো বলুন, আপনাদের দাম কত?

ক্যারি প্যাকার, আপনি ক্রিকেটাঙ্গনের মানুষ। তবু ক্রিকেটীয় শব্দের পরিবর্তে আপনার জন্য বণিক শব্দটিই ব্যবহার করলাম।আপনি এতে অসন্তুষ্ট হওয়ার কথা না। কারণ, ক্রিকেটের প্রতি সামান্যতম ভালবাসা থেকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি আদৌ। আপনি এর মধ্যে টাকার গন্ধ পেয়েছিলেন আর সেটা কুক্ষিগত করার প্রয়াসেই ক্রিকেটে উদ্দীপনা পেয়েছিলেন।

ব্যবসায়ীদের জন্য এটা করা দোষের কিছু না। কিন্তু হয় কি, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে যখন খেলার স্পিরিটকে কলঙ্কিত করে অভিযোগটা তখনই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আপনি নিজের ইগোকে জেতাতে চেয়েছেন সব সময়, অর্থ দিয়েই সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হতে চেয়েছেন।

ক্যারি ফ্রান্সিস বুলমোর প্যাকার নাম নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৭ তারিখে নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনিতে আপনি জন্মগ্রহণ করেন। আপনার বাবা স্যার ফ্রাঙ্ক প্যাকার অস্ট্রেলীয় প্রচার মাধ্যমের সত্ত্বাধিকারী ছিলেন।

ক্যারি প্যাকার পারিবারিকভাবেই আপনি বিত্তশালী। আপনার বাবা মারা যাওয়ার সময় ১০০ মিলিয়ন ডলার রেখে গিয়েছিলেন। এই বিপুল পরিমাণ কর্থ কাজে লাগিয়ে আপনি আরো অর্থশালী হবেন এতে অবাক হওয়ার কথা নয়! অস্ট্রেলিয়ার বিজনেস রিভিউ উইকলি ম্যাগাজিনের ২০০৪ সালের সংখ্যার আপনার সম্পদের আনুমানিক হিসাব ধরেছিল ৬.৫ মিলিয়ন ডলার।

বিশ্বে আপনিই প্রথম মানুষ যিনি ক্রিকেট খেলা টেলিভিশনে সম্প্রচার করে অর্থ উপার্জন করেছেন। সম্ভবত একারণেই খেলাটির প্রতি আপনার আগ্রহ বেড়েছিল। নইলে সংবাদপত্র আর প্রকাশনী সংস্থার ব্যবসার সাথে ক্রিকেট ব্যবসা সেভাবে মেলে না।আপনি কিছুটা খেয়ালি বাদশার মত, যে যখন যা ইচ্ছা তাই করতে চায়।

ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট আয়োজনে ইংল্যান্ড অধিনায়ক টনি গ্রেগ আপনাকে খেলোয়াড় সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। প্রতিদানে আপনি তেমন কিছু চিন্তা না করেই তাকে চ্যানেল নাইন নেটওয়ার্কে আজীবন চাকরি দিয়ে দিলেন। সত্যি অদ্ভুত ছিল, কারণ ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট শুরু করেছিলেন শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ডকে নিজের ক্ষমতা জাহির করার জন্য।

অ্যাশেজ টেস্ট সম্প্রচার-স্বত্ব পাননি বলে ক্রিকেটের এত বড় ‘ক্ষতি’ করতে হবে! আপনি সব দেশের নামি ক্রিকেটারদের মোটা অংকের অর্থ দিয়ে নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ খেলতে হয়েছিল অবসরে যাওয়া ববি সিম্পসনকে ফিরিয়ে এনে।

অর্থের দম্ভের এক পর্যায়ে আপনি অস্ট্রেলিয়ান বোর্ডকেই কিনে নিতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালের সেই ঐতিহাসিক মিটিংয়ে আপনি তাদের বলেছিলেন, ‘জেন্টেলম্যান, আমাদের সবার মধ্যে একটু-আকটু বেশ্যা লুকিয়ে থাকে। তো বলুন, আপনাদের দাম কত?

এতদূর অবধি পড়ার পর পাঠকেরা ভাববেন আমি আপনাকে ক্রিকেটের বিষ হিসেবে পরিচিত করছি। এমনটি মনে হওয়া সম্পূর্ণ ভুল। অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট বোর্ড আর আইসিসিকে এক হাত নিতে গিয়ে আপনি যে অজ্ঞাতসারেই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় উপকার করেছেন তা যে কোন মানুষই একবাক্যে স্বীকার করবে। ওয়ার্ল্ড সিরিজের ক্রিকেটের পরই বোর্ডগুলো অনুধাবন করে ক্রিকেটারদের খুবই নিম্ন পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়, যা দিয়ে সংসার চালানো দুঃসাধ্য।

আপনার দেখাদেখিই ক্রিকেটারদের জন্য বেতন চালু করা হয়, ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পুরো কৃতিত্ব আপনার। আপনার মাহাত্ম্য আরো গভীর। সাদা পোশাক আর লাল বলের চৌহদ্দি পেড়িয়ে রঙিন পোশাক, সাদা বল আর দিবারাত্রির ম্যাচের পরিমণ্ডলে ক্রিকেট প্রবেশের একক কৃতিত্ব আপনাকেই দিতে হবে।

বর্ণবাদের কারণে আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিষিদ্ধ করলো, আপনি আইসিসির তোয়াক্কা না করে ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের চুক্তিবদ্ধ করলেন।

মৃত্যুও সহজে জিততে পারেনি আপনার সাথে। চার বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, একবার তো ছয় মিনিটের জন্য ক্লিনিকালি ডেডও হয়ে গিয়েছিলেন, তবু হার মানেননি। শেষ পর্যন্ত কিডনি রোগের কাছে হার স্বীকার করলেন। ডাক্তাররা অবশ্য বলেছিল, চিকিৎসা করালে আরো কিছুদিন টিকবেন। কিন্তু নিজের শরীরকে ভালই চিনতেন আপনি, তাই ডাক্তারদের জানিয়ে দিলেন, ‘আমার গাড়ির পেট্রোল ফুরিয়ে এসেছে, অযাচিতভাবে জীবনের দৈর্ঘ্য না বাড়িয়ে সম্মানের সাথে মরাই ভাল।’

২৬ ডিসেম্বর, ২০০৫ তারিখে ৬৮ বছর বয়সে নিউ সাউথ ওয়েলসের সিডনিতে আপনার দেহাবসান ঘটে।

হয়তো বা এত সব অবদানের কারণে আপনার মৃত্যুতে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এই সম্মাননা কি আপনার জন্য যথার্থ বলুন? টসের কয়েনে আপনার ছবি দেখলে আপনার প্রতি সম্মানটা যথার্থ হয়েছে বলে ভেবে নিতাম।

টনি গ্রেগ যথার্থই বলেছেন, ‘ক্রিকেটের এমন কোনো ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়, যেখানে ক্যারি প্যাকার নামটি উহ্য থাকবে।’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...