অস্ট্রেলিয়ান পেস কিংবদন্তি ডেনিস লিলি একবার বলেছিলেন, ‘জিওফ বয়কট শৈশবে নিজের প্রেমে পড়েছিলেন, আর সেই ভালবাসা চিরকাল অটুট ছিল।’ নি:সন্দেহে বয়কট দারুণ একজন ওপেনার ছিলেন, তবে কখনোই একজন টিমম্যান ছিলেন না। এমন অসংখ্য নজীর আছে, যখন দল রাতের পার্টিতে মজে ছিল তিনি তখন হোটেল রুমে আয়নায় দাঁড়িয়ে শ্যাডো প্র্যাকটিস করছেন।
একালের জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকারের প্রতিভা নিয়ে কোনোকালেই সন্দেহ ছিল না, কার্যকারিতাও ছিল আকাশচুম্বি। একটা সময় তিনি টেস্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানেরও মালিক ছিলেন। ব্যাটিং টেকনিকও ছিল অসাধারণ। কিন্তু, দ্বৈত চরিত্র আর নিজের প্রতি অবসেশনের কারণে সমালোচিত হতেন সমান ভাবে।
একটা উদাহরণ এক্ষেত্রে না দিলেই নয়।
ট্রেন্ট ব্রিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলছে ইংল্যান্ড। এমন একটা উইকেট যেখানে দিনে পর দিন টিকে থেকে রান করা যায়। আরেক ওপেনার ডেনিস অ্যামিসের সাথে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হন বয়কট। ড্রেসিংরুমে ফিরে বয়কট দেখেন দিব্যি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন অ্যামিস।
রাগ ধরে রাখতে পারেন না বয়কট। গালি দিয়ে বলে ফেলেন, ‘ও আমার সব রানগুলো করে ফেলছে।’ ম্যাচ শেষে তিনি অ্যামিসকে পরের টেস্টে রান আউট করার হুমকি দেন!
সংকটময় পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসেন অধিনায় রে ইলিংওর্থ। সাফ বলে দেন, ‘ওপেনার দু’জন নিজেদের মধ্যে মিটমাট না করে ফেললে আর তাঁরা আর আমার দলে খেলতে পারবে না।’ বয়কট থোড়াই কেয়ার করেন, হাত মেলাতেও অস্বীকৃতি জানান।
তিনি দ্রুত ঘটনা ভুলেও যাননি। অ্যামিসই এগিয়ে আসেন। কয়েক সপ্তাহ পর বয়কটের বাড়িতে ফোন দেন। ফোন ধরেন বয়কটের মা। কথোপকথনটা ছিল এমন।
– জিওফ আছে বাড়িতে?
– আছে, ডেকে দিচ্ছি। কে বলছেন?
– আমি ডেনিস অ্যামিস।
– না, ও বাড়িতে নেই।
কেটে যায় ফোন। বোঝাই যাচ্ছে একগুঁয়ে স্বভাবটা তাঁদের পারিবারিক। সেটা এতটাই যে বয়কট ক্যারিয়ারের প্রায় পুরোটা সময় দল থেকে নিজেকে ‘বয়কট’ করে দিব্যি খেলে গেছেন, পারফরমও করেছেন। মাত্র আট বছর বয়সেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন বয়কট। কে জানে, সেই ঘটনাই হয়তো তাঁকে নিজেকে আরো বেশি ভালবাসতে শিখিয়েছে।
রক্ষনাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য বিখ্যাত ছিলেন বয়কট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রান না করেও উইকেটে টিকে থাকার বিরল ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা বিরক্তির উদ্রেকও করতো। তবে, প্রয়োজনে সেটাকে ভাঙতেও জানতেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে লর্ডসে জিলেট কাপের ফাইনালে সারের বিপক্ষে যে ১৪৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তাতে ছিল ১৫ টি চার ও তিনটি ছক্কা।
বয়কট চাইলে টেস্টে প্রথম ইংলিশ হিসেবে ১০ হাজার রানের মাইলফলকে পৌঁছাতে পারতেন তিনি। কিন্তু, ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ – এই তিন বছর তিনি দল থেকে দূরে ছিলেন বিষণ্নতার কারণে টেস্ট ক্রিকেট থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলায়। এই সময় ইংল্যান্ড দল ৩০ টি টেস্ট খেলে।
ক্রিকেট থেকে বয়কটের বিদায়টা হয়েছে খুবই বাজে ভাবে। ১৯৮১-৮২ মৌসুমে ইডেন গার্ডেন্সে তিনি অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ফিল্ডিংয়ে নামেননি। বদলী নামাতে বাধ্য হয় ইংল্যান্ড। ইংলিশরা যখন ফিল্ডিংয়ে, তখন তাঁকে গলফ খেলতে দেখা যায়। এরপর তাঁকে আর জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করা হয়নি। পরে তিনি বলেছিলেন, ওই সময় তাঁর মুক্ত বাতাস দরকার ছিল!
জীবনে কখনোই অর্জনের কমতি হয়নি বয়কটের। তিনি ব্রিটেনের সর্বোচ্চ সম্মাননা অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার লাভ লাভ করেন। নামের সাথে যুক্ত হয় ‘স্যার’। তবে, ১৯৯৮ সালের এক ঘটনায় নাইটহুড স্থগিত করা হয়। সেবার প্রেমিকাকে মারধোরের অভিযোগে ফরাসি আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়।
বয়কটের নামের সাথে ক্রিকেটের দারুণ একটা রেকর্ড জড়িয়ে আছে। ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের পাঁচ জানুয়ারি। সেই ম্যাচের প্রথম বলটা ব্যাট হাতে সামলান বয়কট। প্রথম ওয়ানডের প্রথম আউট হওয়া ব্যাটসম্যানও তিনিই!