আগ্রাসনের পতাকা হাতে সেনাপতি

সময়টা ২০০০ সাল, ফিক্সিং কাণ্ডে ভারতীয় ক্রিকেটে নেমে এসেছিল ক্রান্তিকাল। ভারতের বেশিরভাগ সিনিয়র এবং অভিজ্ঞ খেলোয়াড় অ্যান্টি করাপশন ইউনিটের তদন্তের অধীনে ছিল। এবং ম্যাচ ফিক্সিং কেলেঙ্কারির প্রেক্ষিতে পূর্ববর্তী অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন সেসময় পদত্যাগ করেছিলেন।

বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়াকে (বিসিসিআই) তখন একজন উপযুক্ত অধিনায়কের সন্ধানে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছিল। ভারতের দেয়াল খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়কে তখন অধিনায়কত্বের দায়িত্ব নিতে প্রস্তাব দেয় বিসিসিআই, কিন্তু দ্রাবিড় সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।

বাধ্য হয়েই টিম ম্যানেজম্যান্ট অধিনায়কত্ব তুলে দিয়েছেন এক অহংকারী এবং আক্রমণাত্মক ক্রিকেটারের হাতে। তিনি কলকাতার বাঙ্গালি ছেলে, সৌরভ গাঙ্গুলি। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসাবে তাঁর অধিনায়কত্বের সময় তিনি যা করেছিলেন সেটি বিপ্লবী থেকে কম কিছু নয়।

সৌরভ ঘরোয়া এবং অনূর্ধ্ব ১৯ দল থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের নিয়ে আসেন যারা পরবর্তীতে ভারতীয় ক্রিকেটের স্তম্ভ হয়েছিল। এর পাশাপাশি ক্রিকেটের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তিনি।

এই আগ্রাসী অধিনায়কের মূলমন্ত্র ছিল অনবরত আক্রমণ এবং আক্রমণাত্মক মনোভাব। স্লেজিং এবং টিজিংয়ের মুখে শান্ত থাকার পুরোনো অভ্যাসেও পরিবর্তন এনেছিলেন সৌরভ। অজি কিংবা ইংলিশদের কটূক্তির সমান জবাব দিয়েছে গাঙ্গুলির দল। আর এই সবকিছুতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন স্বয়ং অধিনায়ক নিজে। 

ব্যাট কিংবা মুখে – সৌরভ গাঙ্গুলির এমন আগ্রাসী আচরণ দেখে অবাক হয়েছিল বিশ্ব ক্রিকেট। এমনকি এসবের ফলে গাঙ্গুলিকে প্রায় ম্যাচ রেফারিদের কাছে ব্যাখ্যা দিতে হতো। তাছাড়া এই বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যানকে জরিমানা করা হয়েছে নিয়মিত।

তবে থেমে যাননি সৌরভ গাঙ্গুলি। পুরো দলের মাঝে নিয়ে এসেছেন আক্রমণাত্মক মনোভাব, ক্রিকেটের মোড়ল দেশগুলোর বিপক্ষে চোখে চোখ রেখে লড়তে শিখিয়েছেন তিনি।

কলকাতা টেস্টে প্রায় নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে বেঁচে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারত একটি নতুন শক্তি হিসেবে উত্থাপিত হয়েছিল। আর এটির নেপথ্যে ছিলেন একজন সৌরভ গাঙ্গুলি। 

অবশ্য অধিনায়ক সৌরভ এমন আক্রমণাত্বক ছিলেন ব্যাপারটি তেমন নয়। খেলোয়াড় হিসেবেও গাঙ্গুলি ছিলেন একরোখা। ১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। অভিষেকটা মন মত হয়নি, তবে পরবর্তীতে আরো কয়েকটা ম্যাচে হয়তো তিনি সুযোগ পেতেন।

কিন্তু হুট করেই দল থেকে বাদ পড়েন এই ব্যাটসম্যান; গুঞ্জন উঠেছিল সিনিয়রদের জন্য মাঠে ড্রিংকস বহন করতে আপত্তি জানানোয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচকরা। 

মাঠের ঔদ্ধোত্যপূর্ণ আচরণের জন্য সৌরভ গাঙ্গুলিকে কলকাতার যুবরাজ হিসাবে ডাকা হয়। এবং সবাই সত্যিই মনে করেন তিনি এই শব্দের যোগ্য।

খেলার প্রতি সৌরভ গাঙ্গুলির আবেগ তাকে সবার থেকে আলাদা করেছে। বিশ্বের সেরা দলগুলোর আগ্রাসন এবং আধিপত্যের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট আন্তর্জাতিক পর্যায়েও একটি নতুন যুগে পা রেখেছিল। এমনটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র গাঙ্গুলির নেতৃত্বের কারণে। 

আইসিসির বড় টুর্নামেন্ট কিংবা বড় দলের সঙ্গে তাঁর ব্যাটেই স্বস্তি পেয়েছিলো ভারত। সামনে থেকে নেতৃত্বে দিয়ে ২০০০ সালের আইসিসি নকআউট ট্রফির ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন টিম ইন্ডিয়াকে।

এছাড়া ২০০৩ বিশ্বকাপে তার ব্যাটে রানের ফোয়ারা সৃষ্টি হয়। তার অসাধারণ নেতৃত্ব এবং ৫৮.১২ গড়ে ৪৬৫ রানে ভর করেই ১৯৮৩ সালের ২০ বছর পর আরো একবার এই বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে পৌঁছে ভারত। অবশ্য ফাইনালে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারেনি এশিয়ান পরাশক্তিরা।

অধিনায়ক থাকা অবস্থায় একাধিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সৌরভ। বোর্ডের উপর প্রভাব বিস্তার, টসের সময় দেরী করে মাঠে আসা আর লর্ডসের সেই উদ্দাম উদযাপন – এমন সব কাজের জন্য বহুমুখী সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল তাকে। তবে মাঠে নিজেকে ঠিকই উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি।

ক্রমাগত ব্যর্থতা, স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি এবং হারের চক্রে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার পর শুধুই ইতিহাস রচনা করেছেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্বে বদলে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটকে।

তার হাত ধরেই ভারত উঠে আসে ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে, টেস্টে তিনে। তৎকালীন সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের সাথে কেবল গাঙ্গুলির ভারতই প্রতিযোগিতা করতে পারতো। অধিনায়ক হিসেবে গাঙ্গুলি’র তুলনা আসলে তিনি নিজেই। তিনিই আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেট বিপ্লবের মূল কাণ্ডারি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link